হারানো বৈচিত্র্যের খোঁজে
সিদ্ধেশ্বর হাটুই
জীব বৈচিত্র্য বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আলোচনা করা খুবই জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আমরা কম-বেশি সকলেই জানি আমাদের প্রকৃতি মাতার কোল থেকে অনেক প্রজাতির পশু,পাখি,এবং উদ্ভিদ হারিয়ে যাচ্ছে, বর্তমানে আমরা আর তাদের দেখা পাচ্ছিনা। এর জন্য দায়ী কারা, একথা জানতে আমরা ভুলে গেছি। আবার অনেকের মনে হতে পারে- আমার জীবিকা আমি সঠিকভাবে করে চলি তাহলেই হবে । ঐ সমস্ত ব্যাপারে নাক গলিয়ে লাভ নেই। তাহলে ক্ষতিটা হচ্ছে কার? কারো একার জন্য তারা হারিয়ে যায়নি, এর জন্য আমরা সকলেই দায়ী, লোকসানটা সবারই হচ্ছে। তাই সকলের এ বিষয়ে ভাবার সময় দোরগোড়ায়। অন্যথায় আমাদের সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হবে, সেদিন আর কিছু করার থাকবে না।
জীবগোষ্ঠীর মহান বাসভূমি হলএই পৃথিবী। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ছোটো-বড়ো উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাবেশ লক্ষ্য করাযায়। পৃথিবীর যে কোনো স্থানে বিভিন্ন প্রকার জীবের এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাবেশই হল জীববৈচিত্র্য। এই জীব বৈচিত্র্য রক্ষা না করলে পৃথিবীর ভারসাম্য আরো ধ্বংসের মুখে চলে যাবে।
বিশেষ করে গ্রাম –গঞ্জের পাশাপাশি ছিল প্রচুর গাছপালা, বন-বাদাড়, ঝোপঝাড় ও লতাগুল্মে সমৃদ্ধ। বন-বাদাড়ে, ঝোপ ঝাড়ে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্ম নিতো ভেষজগুণ সমৃদ্ধ শত শত প্রজাতির উদ্ভিদ, সেগুলো আর জন্মায় না। যেমন-থানকুনি, অর্জুন, মেহগিনি, কালো তুলসী, রাম তুলসী, মেহেদি, চন্দন, বহড়া, হরিতকি, অগ্নিশ্বর, রক্তচিতা, দুধরাজ, ফণিমনসা, ন্যাড়াসেজার, কালমেঘ, বনধনে, লজ্জাবতী, বিষকাটালী, নীলকণ্ঠ, আকন্দ, সর্পগন্ধ্যা, বিশলা সতমূল,অনন্তমূল, সাদা কাঁটাবেগুন , যজ্ঞ ডুমুর, ভুই আমলা, স্বর্ণলতা ঈশ্বরীমূল সহ বিভিন্ন গাছ। ফলে প্রয়োজনীয় গাছ-গাছড়ার জন্যও চিন্তাভাবনা করতে হতো না। হাতের সামনেই পাওয়া যেত ।
আমাদের মধ্যে থেকে আজ অনেক প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন:——পিন্টা আইসোল্যান্ড টরটয়েজ- ২০১২ সালে লুপ্ত হয়ে যায় কচ্ছপের এই প্রজাতি। ওয়েস্ট আফ্রিকান ব্ল্যাক রাইনোসরাস- ২০০৬ সালেই পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যায় কালো গন্ডারের এই প্রজাতি। জাভান টাইগার- বাঘের এই প্রজাতি ১৯৭০ সালেই পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যায়। জঙ্গলে যে সমস্ত খরগোস পাওয়া যেত তাদের মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি লুপ্ত প্রায়। আবার দেখুন মানুষের এক্কেবারে পাশাপাশি থাকা চড়ুই পাখি, এবং চিল, কাক সহ আরো অনেক পাখি যারা আমাদের ছেড়ে ধিরে ধিরে হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে গ্রমাঞ্চলে খাল,পুকুর , এমনকি মাঠে-ঘাটে কত রকমের ছোট ছোট মাছ পাওয়া যেত , পাড়া-গ্রামের ছেলে-মেয়েরা দলবদ্ধ ভাবে মাছ ধরতে যেত। কিন্তু বর্তমানে তারা হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় আসবে টাকা দিয়ে কেন, কনো মূল্যেই তাদের আর পাওয়া যাবেনা।
আমরা বই পড়ে জানতে পেরেছি জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ রয়েছে। যেমন一প্রাকৃতিক কারণ-জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগে একাধিকবার জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। এর পরিবর্তনের সাথে বিভিন্ন প্রজাতি আভিযোজন ঘটাতে না পারায় তাদের বিলুপ্তি হয়।
বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ও সুনামি ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে বহু প্রজাতির জীবের বিনাশ ঘটে ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়।এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক জীব লুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আবার অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে সৃষ্ট লাভা প্রবাহে বহু প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটে।মহাকাশ থেকে আগত ধূমকেতু পৃথিবীপৃষ্ঠে আছড়ে পড়লে সেখানকার জীবের মৃত্যু ঘটে।
মানুষ্যসৃষ্ট কারণ—মানুষের আবাসস্থলের বৃদ্ধি- পৃথিবীতে জনসংখ্যার অত্যধিক চাহিদা পূরণ করার জন্য নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। জঙ্গল কেটে গ্রাম আর গ্রাম থেকে হয়ে শহর-নগর। এর ফলে উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে ও তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থলগুলিও সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে।
বাইরে থেকে হঠাৎ যদি কনো প্রজাতি আসে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের গঠন বিনষ্ট হয়। এতে স্থানীয় প্রজাতির বৈচিত্র্য ভীষণভাবে হ্রাস পায়। কনো পরিযায়ী পাখি মুখে করে নিয়ে আসে, কিম্বা তার বীজ খেয়ে এসে মলত্যাগ করল, সেই বীজ মাটিতে পড়ে ছারাগাছ জন্ম নিল। যেমন—পার্থেনিয়াম নামক গুল্ম ও কচুরিপানা বিদেশ থেকে এনে এদেশে স্থাপন করায় আমাদের বাস্তুতন্ত্র ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ায় খরগোস আমদানি হওয়ার পর থেকে সেখানকার অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ খেয়ে ফেলার জন্য বিনষ্ট হয়ে গেছে।
মানুষের প্রয়োজনে লালসার কারণে পশু শিকারবা মৃগয়া করার ফলে সেই সমস্ত প্রজাতিগুলি ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া, গন্ডারের খড়গ প্রভৃতির বিক্রি করার জন্য সেই জীবদের এমন হারে হত্যা করা হয়েছে যে বর্তমানে তারা বিলুপ্তপ্রায় বলে গণ্য হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো তাদের দেখা পাওয়া যাবে না। এর জন্য কারা দায়ী?
প্রয়োজনের অধিক বৃক্ষছেদন- বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি তাদের চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে বনাঞ্চল থেকে নির্বিচারে বিভিন্ন বৃক্ষলতা ও গুল্ম আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনাঞ্চল থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন গুল্মগুলি সংখ্যায় অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। নিয়ন্ত্রনের কনো প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নেই। তাদের জন্য আইন করে শাস্তির ব্যাবস্থা করতে হবে। আর যদি আইন হয়েও থাকে তার ব্যবহারের জায়গাটা উহ্যই থাকছে ।
এছাড়াও প্রকৃতিতে জলদূষণ, বায়ুদূষণ ও মৃত্তিকাদূষণের মাত্রা প্রভূত পরিমাণে বাড়ছে। মাত্রাতিরিক্ত আধুনিক বিজ্ঞানের তৈরী কীটনাশক ব্যাবহার এবং তার বিষক্রিয়া এবং দূষণের ফলে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। প্রকৃতিতে প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ার পিছনে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত কীটনাশকেই দায়ী।
আজকে যে ফসলের ওজন এক কেজি ভিটামিন প্রবিষ্টকরণ করার ফলে পরের দিন দুই কেজি হয়ে য়ায় । ধরুন আজকে ফসলে কীটনাশক স্প্রে করা হল, সেই ফসল কালকেই চলে যাচ্ছে বাজারে। এক্ষেত্রে চাষির লাভ হলেও, সর্বদিক বিচারে সবার ক্ষতি হচ্ছে। আমরা ইথিলিন পলিমারে এত বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছি যে পলিব্যাগ ছাড়া একটি দিন চলেনা।এগুলি আমরা ব্যাবহার করি আর মাটিতে ছুড়ে ফেলি । মাটিতে ফেললেও দীর্ঘ পাঁচ বছরেও নষ্ট হয় না। এসমস্ত জেনেও আমরা করে থাকি। আমরা তো মহান জ্ঞানপাপী।
উন্নয়নমূলক কাজে হাত দেওয়ার আগে পরিবেশের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে সমীক্ষা না করেই কাজ শুরু করে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে জঙ্গল কেটে কণস্ট্রাকশনের কাজ করা হয়। এর ফলে বন্য প্রাণী বসবাসের ক্ষেত্রে বাধাদান করে। সেদিকেও কড়া নজর রাখা প্রয়োজন প্রশাসনের।
সম্পূর্ণ পৃথিবীজুড়ে আধুনিক সমাজ যেমন গড়ে উঠছে। গড়ে উঠছে বড় বড় শিল্প- শহর, হ্রাস পাচ্ছে জঙ্গল , হ্রাস পাচ্ছে মানুষের মানবিকতা। এমনও মানুষ আছেন যারা সারা জীবনে একটি গাছও রোপণ করলেননা। অথচ সেই গাছই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এটা অকৃতজ্ঞতার পরিচয়।
আমরা সকলেই প্রকৃতির দান, প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে আমাদের সকলকে সচেতন হয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য যাহাতে সঠিক থাকে সেদিকে নজর রাখতে হবে। প্রকৃতিকে ভালোবাসলে প্রকৃতি আমাদের ভালোবাসবে এটাইতো স্বাভাবিক। আর প্রকৃতি অসুস্থ হলে আমরাও সকলে অসুস্থ। ইং-২০২১- ২০২২ সালের মহামারি তার প্রমান রেখে চলছে। আসুন সকলে মিলে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলি। সকলে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করলে আশা করি আমরা প্রকৃতির ভারসাম্য সঠিক রাখতে পারবো আর নিজেদের জীবন সানন্দে কাটাবো এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী উপহার দিয়ে যাবো। এই অঙ্গীকারই হোক জীবনের মহামন্ত্র।
