
ব্যাধের গুপ্তধন
সঞ্জিত তির্কী কাব্যিক
জ্ঞান লাভের জন্য বড়,ছোট,উচ্চজাতি,নিম্নজাতি বিচার মূর্খতা মাত্র।উপনিষদেও আমরা দেখতে পাই যে,ব্রাহ্মণ শ্বেতকেতু ক্ষত্রিয় প্রবাহন জৈবলির কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করেছিলেন।নীচবৃত্তিসম্পন্ন ব্যাধের যে জ্ঞান তা উচ্চবৃত্তিসম্পন্ন ব্রাহ্মণ বংশের কৌশিকের ছিল না।তাই বলতে পারি আমরা স্বকর্মে প্রতিষ্ঠিত থেকে সেই সূক্ষ্ম জ্ঞান লাভ করতে পারি।পুত্রেরা মাতা ও পিতার যে শূশূষা করে,স্ত্রীলোকের ভর্তার যে পরিচর্যা করে এবং স্ত্রীলোকদের যে ভয়ঙ্কর পতিব্রতা ধর্ম,ইহাপেক্ষা অন্য সুকঠিন কর্ম আর জগতে দেখা যায় না।যত্নপরায়ণ সাধ্বীরমণীগনের পতিসেবা এবং পুত্রদের মাতা পিতার পরিচর্যা অতি সুকঠিন কার্য।
এক পতিপরায়ণা ও সত্যভাষী নারীগণ ঋতুকালে দশমাস গর্ভধারণ করিয়া অতুলনীয় বেদনা অনুভবপূর্বক পরম সন্দেহযুক্ত হইয়া থাকে অর্থাৎ সুসন্তান হইবে না কু সন্তান হইবে জানিতে না পারিয়া।মহা কষ্টে সন্তান প্রসব করেন এবং অতিশয় স্নেহযুক্ত হইয়া তাহার লালন পালন করেন।
তাহা অপেক্ষা অদ্ভুত কার্য আর কি হয়তে পারে?তবুও নারী জাতিকে অবহেলা করা হয়।যে মা হচ্ছেন সকল শক্তি উৎস।গৌরবের দিক হইতে অনেকে মাকে,আবার অনেকে পিতাকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন। পিতা মাতা উভয়েই সন্তানের যশ,কীর্তি,ঐশ্বর্য আকাঙ্ক্ষা করিয়া থাকে।যে পিতা মাতার সকল আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে সেই ধর্মজ্ঞ।যার প্রতি পিতা মাতা সন্তুষ্ট থাকেন তাহার ইহ ও পরলোক,কীর্তি ও ধর্ম চিরস্থায়ী।বেদধ্যায়ী,তপোধন,তপঃপরায়ণ ও ধার্মিক কৌশিক নিয়ে নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। একদিন তিনি বৃক্ষমূলে বসে বেদাধ্যয়ন করছিলেন।সেই বৃক্ষের উপরে একটা বকপক্ষিণী ছিল।হঠাৎ বক পক্ষিণী ব্রাহ্মণের মাথার উপর বিষ্ঠা ত্যাগ করিল।তখন ব্রাহ্মণ ক্রোধান্বিত হয়ে তাহার মৃত্যু কামনায় ক্রোধাভিভূত হইয়া তাহার দিকে দৃষ্টি পাত করল।ক্রোধান্বিত দৃষ্টিপাতের ফলে বকপক্ষিণী মাটিতে পতিত হইল।সেই কার্য দেখিয়া ব্রাহ্মণের সর্বপ্রকারের সন্তপ হইয়া শোক হইল।
ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করার জন্য পবিত্র বাড়িগুলো বিচরন করিতে করিতে সেই বাড়িতে প্রবেশ করিলেন যেখানে পূর্বেও গিয়েছিলেন।ব্রাহ্মণ ভিক্ষা জন্য প্রার্থনা করিলে বাড়ির যশস্বিনী বলিলেন অপেক্ষা করুন।যখন যশশ্বিনী ভিক্ষার পাত্রটি পরিষ্কার করছিলেন তখন তাহার স্বামী অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হইয়া প্রবেশ করিলেন।সেই সাধ্বী যশস্বিনী পতিকে দেখিয়া ব্রাহ্মণকে পরিত্যাগ করিয়া খাবার দিলেন।অতঃপর সেই নীলনয়না যশস্বিনী নম্রভাবে সুমধুর ভক্ষ্য,ভোজ্য আহার্য্যের দ্বারা স্বামীকে পরিচর্যা করিলেন।নীলনয়না যশস্বিনী সর্বদা সংযতেন্দ্রিয় থাকিয়া দেবতা,অতিথি,ভূভ্য,শ্বশ্রূ ও শ্বশুর -শাশুড়ি সেবা করতেন।
অনন্তর সুলোচনা যশস্বিনী পতি সেবা করিতে করিতে ব্রাহ্মণকে দেখিয়া তিনি যে ভিক্ষার জন্য দাঁড়াইয়া রইলেন ইহা স্মরণ হইল।যশস্বিনী গৃহিণী লজ্জিতা হইলেন এবং ব্রাহ্মণের জন্য ভিক্ষা লইয়া নির্গত হইলেন।ব্রাহ্মণ বলিলেন-বরবর্ণিনি?
ইহা কিরুপ হইল?আপনি আমাকে বিদায় করিলেন না।যশস্বিনী বলিলেন-হে জ্ঞানী ব্রাহ্মণ! আমাকে ক্ষমা করুন।স্বামী আমার নিকট প্রধান দেবতা।তিনি ক্ষুধা র্ত অবস্থায় উপস্থিত ইহয়াছিলেন,আমি তাহার শুশ্রূষা করিয়াছি।ব্রাহ্মণ বলিলেন-ব্রাহ্মগণ তোমার কাছে শ্রেষ্ঠ হইলেল না,তোমার পতিই শ্রেষ্ঠ হইলেন।গৃহস্থ ধর্মে থাকিয়া ব্রাহ্মগণের অবমাননা করিতেছ।তুমি জান-ইন্দ্রও আমাদের নমষ্কার করে,পৃথিবীর গর্বিতে?মানুষের কথা আর কি বলিব।হে গর্বিতে?তুমি নিজেও জান না,বৃদ্ধদের কথা শোন নাই যে অগ্নিতুল ব্রাহ্মণগণ পৃথিবীকেও দগ্ধ করিতে পারে।যশস্বিনী বলিলেন-“হে নিষ্পাপ ব্রাহ্মণ!মনস্বী দেবতুল্য ব্রাহ্মণগণকে আমি অবজ্ঞা করি না,অতএব আমার এই অপরাধ ক্ষমা করিবেন।হে ব্রাহ্মণ!
মহাত্মা ব্রাহ্মণদের এইরুপ বহুতর প্রভাবের কথা শুনিতে পাই।আর মহাত্মাদের ক্রোধ ও করুণা উভয়ই গুরুতর হইয়া থাকে।হে নিষ্পাপ ব্রাহ্মণ! আমার অতিক্রমের জন্য আমাকে ক্ষমা করিবেন।হে ব্রাহ্মণ! পতিসেবার ধর্ম আমার ভালো লাগে।কারণ সকল দেবতার মধ্যে পতিই আমার পরম দেবতা।হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ পতিসেবারুপ ধর্ম আমি নির্বিশেষে করিয়া থাকি।হে ব্রাহ্মণ!পতি শুশ্রূষার যেরূপ ফল হইয়াছে তাহা প্রত্যক্ষ করুন।আপনি ক্রোধবশতঃ বকপক্ষিণীকে দগ্ধ করিয়াছেন তাহা আমি জানিতে পারিয়াছি।হে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ!ক্রোধ মানুষের শরীরস্থ শত্রু।সনাতন ধর্ম দুর্জ্ঞেয়,তবে তাহা সত্যে প্রতিষ্ঠিত,বেদই তাহার প্রমাণ।হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ!ধর্ম বহুবিধ হইলেও সূক্ষ্ম।আপনি ধর্মজ্ঞ,বেদপাঠনিরত,পবিত্র তথাপি আপনি যথার্থ ধর্ম জ্ঞাত নহেন -ইহাই আমার অভিমত।হে ব্রাহ্মণ!যদি যথার্থ ধর্ম না জানেন তাহা হইলে মিথিলপুরীতে যাইয়া ব্যাধকে জিজ্ঞাসা করিবেন।মাতাপিতার শুশ্রূষাকারী,সত্যবাদি,জিতেন্দ্রিয়,এক ব্যাধ মিথিলায় বাস করেন।তিনি আপনার নিকট ধর্মতত্ত্ব বলিবেন,অনন্তর আপনার যথা ইচ্ছা গমন করুন।
আপনার মঙ্গল হউক। হে অনিন্দিত!আমি অনেক অতুক্তি করিয়াছি, আমায় ক্ষমা করিবেন।কারণ যাঁহারা ধর্ম বিচার করে তাঁহাদের পক্ষে স্ত্রীলোক মাত্রই অবধ্য।ব্রাহ্মণ বলিলেন – শোভনে!আমি তোমার প্রতি প্রীতি হইয়াছি,আমার ক্রোধ গত হইয়াছে,তোমার মঙ্গল হউক।আমি মিথিলায় যাইব ও সে কার্যসাধন করিব অর্থ্যাৎ ধর্মতত্ত্ব জানিব। এই বলিয়া ব্রাহ্মণ বিদায় জানালেন এবং মিথিলার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।