
ক্যাচ দেম ইয়াং
সৌদামিনী শম্পা
মেয়ে হলে শুকনো মুখে, শুভেচ্ছা, আহা লক্ষ্মী এলো। ছেলে হলে, এই মিষ্টি কবে খাওয়াচ্ছিস? বক্তব্যের উচ্ছ্বলতাই প্রমাণ দেয় খুশির। প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে আজও, দেখবি তোর সুন্দর ছেলে হবে। ভুলেও বলে না, তোর সুন্দর একটা মেয়ে হবে। যে বলতে চায়, সেও মুখ ফুটে বলতে পারে না, কারণ দোষের ভাগী হতে চায় না। সমাজকে তো হাড়ে হাড়ে চেনে!
মেয়ে হলে সাত মাসে, পাঁচ মাসে মুখেভাত, ছেলে হলে ছয়, আট! বিভেদ শুরু তো পেটে থাকতেই ছেলে হবে শুনে শুনে। বারে! অভিমন্যু যদি পেটে থাকতে অত কিছু জানতে বুঝতে পারে, তবে এ তার আগমনীর উচ্ছ্বাসটা মাপতে পারবে না?
মেয়েদের জন্য পুতুল, ছেলেদের গাড়ি,বন্দুক। মেয়েদের খেলনাবাটি, তাতে থাকবে কুকিং সেট, ছেলেরা চাইলে মায়ের পরিষ্কার বক্তব্য, তুই মেয়ে নাকি? পুতুল চাইলে, বাবু তুমি না ছেলে! মেয়েদের জন্য কখনো কখনো বন্দুক , গাড়ি কেনা হলেও ছেলেদের জন্য পুতুল, কুকিং সেট, নৈব নৈব চ!
একটু বড় হলেই, মা এটা সিংকে রাখো, ওটা সরিয়ে রাখো, বই গুছিয়ে রাখো, বিছানা টানটান রাখো। ছেলেদের জন্য ওসব নয়। যদিও দুয়েকটা বাড়িতে হচ্ছে তবে শতাংশের হারে তা আর কত?
মেয়ে রাত করে ফিরলে যত শিক্ষিত বাবা মাই হোক, একটু দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দেবেই। ছেলে হলে , ডোন্ট ওরি, বন্ধুদের সঙ্গে আছে। কোনো কোনো ছেলের বাড়িতে যদিও চিন্তা করে কিন্তু মেয়ে হলে , সব বাড়িতেই।
ছোট থেকেই মেয়েরা জামা পরে, স্বাভাবিক। কিন্তু ছেলেদের কেউ শেখায় না, বাবু অন্তত একটা গেঞ্জি হলেও পরে থাকো। ফলে ছেলেরা খালি গায়ে থাকাটা শিখে যায়, আর মেয়েরা তো প্রকৃতির অবদানে বাধ্য হয়ে পোশাক পরে। এখানেও স্পষ্ট, ছেলেরা ছেলে, তারা খালি গায়ে থাকতে পারে, মেয়েরা মেয়ে, তারা খালি গায়ে থাকতে পারে না। ছেলেরা বুঝে যায়, ওরা মেয়ে, ওদের শরীর বিশেষ রকম। মেয়েরাও বুঝে যায় আমরা মেয়ে, আমাদের শরীর বিশেষ রকম। এখানে ছেলেদেরও ছোট থেকেই পোশাক পরা শেখালে কি ক্ষতি? খালি গায়ে থাকাটা অশোভন, উভয় পক্ষেরই। ব্রেষ্ট ছেলে মেয়ে উভয়েরই আছে, একজনের হরমোনের কারণে পরিণত , অন্য জনের নয়। ঢাকতে হলে দুজনের ঢাকাটাই শোভন নয় কি?
উপরের যা যা বললাম, পোশাক বাদে তা একেবারে নিচু স্তরের বা তথাকথিত ছেলে মেয়ের বিভেদ নিয়ে যা বলা হয় সেগুলো বাদেই বলার চেষ্টা করলাম। বাকি গুলো বহু ব্যবহারে ক্লিশে। আরো যে কত আছে তা আর নাই বা বললাম।
কিন্তু মূল বক্তব্য, এই পিতৃতন্ত্রের বীজ জন্মের আগে থেকেই রোপণ হয় মানুষের মধ্যে। বাইরে থেকে তাকে উচ্ছেদ করা অত সহজ নয়। এক কথায় অসম্ভব। যাদের খুব শিক্ষিত উন্নত জাতি বলি, সেখানেও অনেক ক্ষেত্রে, মহিলার প্রবেশ নিষেধ! আমাদের এই উপমহাদেশের কথা তো বাদই দিলাম। ছোট থেকেই পিতৃতন্ত্র মজ্জায় মজ্জায় ইনজেক্ট হচ্ছে। ফলে এটাই চলে আসছে, তাতে মেয়েরা পণ্য , ভোগ্য এটা ভাবছে উভয় পক্ষই। আর আমার মেয়েরা দোষ দিয়ে যাই ছেলেদের।
কিন্তু দোষ পুরুষ জাতির নয়, দোষ এই তন্ত্রের । যার মূল্য মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের ও দিতে হয় পুরুষ মানেই হিরো, সে সব বাইরের কাজ সামলাতে পারে, সব মেয়েদের রক্ষা করতে পারে, এইসব। আর তাতে আগুন দিয়ে যাচ্ছে সিনেমা, সিরিয়ালগুলো। সব সময় নায়িকাকে রক্ষা করে নায়ক। আর উল্টোটা হলেই, কি ম্যাদামারা ছেলে রে বাবা! যেন ছেলে হলেই ইস্পাত আর মেয়ে মানেই ননীর পুতুল! এই যদি চলতেই থাকে, তবে ছেলেদেরও মুক্তি নেই!
আমার এক প্রিয় ছাত্রকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম,তুই পুরুষ হতে চাস, না মানুষ? ও সগর্বে উত্তর দিয়েছিল, পুরুষ। সবাই হেসেছিল। আর ও যে বোকা, গবেট, বোঝে না এমন ছাত্র নয়। তবু ওর বিচারে মনে হয়েছিল, শরীর পুরুষের তাই পুরুষটাই হতে হবে বা হয়। কিন্তু মানুষ হওয়া যে তার চেয়ে বড়,তার চেয়ে সম্মানের তা বেচারার বুদ্ধিতে কুলোয়নি। দোষ ওর নয়, দোষ আমাদের। দোষ চলে আসা ধ্যান , ধারণা, বিশ্বাসের। যার জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে ছেলে, মেয়ে সব্বাই। ছেলেরা ছেলে সাজতে গিয়ে, সহ্য করতে শিখে যাচ্ছে অনেক কিছু, মেয়েরা মেয়ে সাজতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছে অনেক কিছু।
হোক না একটু অন্যরকম। কোনো ছেলে না হয়, কান্না পেলে কাঁদুক, শাড়ি পরতে ইচ্ছে হলে পরুক। তাতে তার লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ নাই বা করলাম। থাকুক সে তার রান্নাবান্না, ঘর গৃহস্থালী নিয়ে।কোনো মেয়ে কলার ধরে জবাব দিক কোনো নোংরা মানুষের।থাকুক কিছু ঘর জামাই, থাকুক কিছু রোজগেরে বৌ, থাকুক কিছু হাউজ হাজব্যান্ড। বদলাক সমাজ। সবাই বাঁচুক নিজের নিজের ভালোলাগায়, নিজের নিজের স্বাভাবিক বাঁচার ইচ্ছেতে, চাপিয়ে দেওয়া কিছুতে নয়।
পিতৃতন্ত্র যেমন গর্ভে থাকতেই তার ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে, আসুন আমরা চেষ্টা করি সেইখান থেকে বদলানোর।তাতে ছেলে মেয়ে, নারী পুরুষ না হয়ে সবাই মানুষ হয়ে তো বাঁচবে!
©® সৌদামিনী শম্পা