Stéphane Mallarmé

প্রবন্ধ

প্রতীকিবাদী কবি স্তেফান মালার্মে
শংকর ব্রহ্ম

[ চারটি পর্বে সমাপ্ত ]

(প্রথম_পর্ব)

সেই রকম একজন কবি স্তেফান মালার্মে, যার কবিতা সম্বন্ধে কমবেশি ধারণা না-থাকলে আধুনিক কবিতা সম্বন্ধে ধারণাও থেকে যায় অসম্পূর্ণ। কেননা, মালার্মে বলেছিলেন, ‘Poetry is the language of a state of crisis!’. (সঙ্কটের ভাষা কবিতা!) তাঁর এই সর্বনাশা যুগান্তকারী উক্তির সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিক কবিতার দিশেহারা আত্মার স্বরূপটি উদঘাটিত হয়ে গিয়েছিল সেই উনিশ শতকের শেষভাগে।

স্তেফান মালার্মে সম্বন্ধে না জানা থাকলে ফ্রান্সের – বিশেষ করে প্যারিসের শিল্পসাহিত্যর ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য অনেকখানিই অজানা থেকে যায়।

কবি স্তেফান মালার্মের জন্ম প্যারিসে- ১৮৪২ সালের ১৮ই মার্চ । তাঁর পিতা নুমা মালার্মের, যিনি প্রপার্টি ( সম্পত্তি) প্রতিমন্ত্রী অফিস কাজ করতেন। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল এতিয়েন মালার্মে। স্তেফান মালার্মে তাঁর Pen Name বা লেখক নাম। স্টিফেন পাঁচ বছর বয়সে তাঁর মাকে হারান এবং তারপর তার বাবা তার শিক্ষার নেন। তিনি ধর্মীয় বোর্ডিং স্কুল, Auteuil অবস্থিত (১৮৫৩ সালে) প্রথম ভর্তি হন, এবং তারপর, ১৮৫৩ সাল থেকে উচ্চ বিদ্যালয় Saëns যোগ দিয়েছিলেন। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা কবির কাছে বেদনাদায়ক মনে হয়েছিল। তার তেরো বছর বয়সী বোন মারিয়ার ১৮৫৭ সালে মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গতা তাকে পেযে বসে। ১৮৬০ সালে তিনি স্নাতক হন। তাঁর পিতা চেয়েছিলেন সে একজন সরকারী কর্মকর্তা হোক , কিন্তু মালার্মের এই কর্মজীবন পছন্দ হয়নি।

এমনকি, তখন তিনি মনে করতেন, তাকে একজন কবি হতে হবে। কবিতা- শৈশব থেকেই লিখতেন। ১৮৬২ সালে বেশ কয়েক মাস জন্য, স্তেফান লন্ডনে ছিলেন। সেখানে তিনি ইংরেজিতে চোস্ত হয়ে ওঠেন। ১৮৬৩ সালে ফ্রান্সে ফিরে এসে তিনি Tournon ইংরেজি শিক্ষক হয়ে ওঠেন। Tournon প্রথম, তারপর Besancon, মধ্যে Avignon সালে (১৮৭১ পর্যন্ত), প্যারিস (১৮৯৪ পর্যন্ত) – সামান্য আয়ের অনুরোধে জন্য শিক্ষা প্রদান করতে, সে এক পরিবারের জন্য বাধ্য হয়েছিলেন, তার জীবনের অন্য দিকে কবিতা ছিল তার প্রাণ। প্রথম প্রথম ফরাসি কবি বোদলেয়ারের প্রভাব ছিল তাঁর লেখায়। ইংরেজির শিক্ষকতাই ছিল তাঁর জীবিকা এবং শিক্ষকতা করার কারণে জীবনভর অর্থনৈতিক দারিদ্র ছিল মালার্মের নিত্যসঙ্গী। তবে মালার্মের হৃদয়ের ঐশ্বর্যের অভাব ছিল না বলেই এই একুশ শতকেও শ্রদ্ধাভরে সকলে স্মরণ করে কবিকে।

প্যারিসের ‘রু দি রোম’ সড়কে ছিল কবির বাড়ি। সে বাড়িতেই বসত ‘সালোন’। ফরাসি ভাষায় ‘সলোন’-এর অর্থ, একটা ছাদের নীচে সমমনস্ক সাহিত্যিকদের আড্ডা। ঐ সময়ে কে যায়নি স্তেফান মালার্মের ‘সালোন’-য়ে ? আইরিশ কবি ওয়াই বি ইয়েটস থেকে শুরু করে জার্মান কবি রিলকে- লেখক আদ্রে জিদ, কবি ও নিবন্ধকার পল ভালেরি, প্রতীকিবাদী কবি পল ভার্লেইন, জার্মান কবি ও অনুবাদক স্তেফান জর্জ, ফরাসি কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও সাহিত্য সমালোচক পিয়েরে জুল থিওফাইল গঁতিয়ে (যিনি বলেছিলেন, শিল্পের জন্য শিল্প …)

অনেকেই যেতেন মালার্মের ‘সালোন’-য়ে। ফরাসি কম্পোজার ক্লোদ দেবসিও যেতেন মালার্মের ‘সালোন’-য়ে। প্রখ্যাত সব ছবি আঁকিয়েরাও যেতেন। বিশেষ করে মাশহুর ফরাসি চিত্রকর এদুয়ার্দ মানে। তাছাড়া ডব্লু.বি.ইয়েটস, রাইনার মারিয়া রিলকে, পল ভালেরি, স্তেফান জর্জ, পল ভার্লেইন সহ অনেকেই তাঁর বাড়ির আড্ডায় নিয়মিত অংশগ্রহণকারী ছিলেন। ১৮৬৩ সালের ১০ই আগস্ট মালার্মে মারিয়া ক্রিস্টিনাকে বিয়ে করেন। তাঁদের একমাত্র কন্যা ‘জেনেভিয়েভ মালার্মে’ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৬৪ সালের ১৯শে নভেম্বর।

বলা বাহুল্য, প্যারিসের রু দি রোম সড়কের বাড়িটির সালোনের মধ্যমনি ছিলেন স্তেফান মালার্মে। তিনি অনর্গল কথা বলে যেতেন ইতিহাস, শিল্পসাহিত্য, কবিতা ও দর্শন নিয়ে। সবাই শুনত। কথা অন্যরাও বলত,তবে তার তুলনায় কম। ‘সালোন’ বসত প্রতি মঙ্গলবার। ফরাসিতে মঙ্গলবার কে বলে- ‘মারদি’। এই কারণে প্যারিসের ‘রু দি রোম’ সড়কের মালার্মের বাড়ির সালোনে যারা যারা নিয়মিত যেতেন তাদের নাম হয়েছিল- মারদিসতেস। বাড়িটি হয়ে উঠেছিল প্যারিসের সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম কেন্দ্র।

কবি স্তেফান মালার্মে ছিলেন ফরাসি দেশের প্রতীকবাদী শিল্প আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যাক্তিত্ব। সেই সময়টায় প্রতীকবাদ ছিল বাস্তববাদের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ। জার্মান দার্শনিক শোওপেনহাওয়ারের দর্শনে প্রতীকবাদের স্ফুরণ ঘটেছিল। বিক্ষুব্দ পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে শিল্পে পরম আশ্রয় নেওয়ার ইঙ্গিত ছিল শোওপেনহাওয়ারের দর্শনে। আধ্যাত্বিক কিংবা অতিজাগতিক প্রতীকবাদীরা নিজস্ব ধারণাকে প্রকাশ করবার জন্য এ ধরণের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিষয় বেছে নিতো। এ ছাড়া ক্ষণিক জীবনের বিমর্ষতা, অতৃপ্ত যৌনবোধও প্রতীকবাদী কবিতায় প্রকাশ পেতো। এ ধরণের বিষয়বস্তু মালার্মের কবিতাতেও রয়েছে।

ক্রমশঃ

Leave a Reply