অশ্বত্থামার অস্ত্র – ২
সুব্রত মজুমদার
দুই
মহাভারত আজও ঘটে
এদিকে যখন গোটা শহরময় সেই সন্ত্রাসবাদীর আতঙ্ক ঘুরে বেড়াচ্ছে উত্তুরে হাওয়ার মতন তখন শহরেরই একটা দোতলা বাড়ির গোপন কক্ষে চলছে কিছু মুখোশধারী লোকের গুরুগম্ভীর আলোচনা। ভালোভাবে শুনলেই বোঝা যাবে যে সে আলোচনা মোটেও কোনও সুখকর কিছু নয়। শহরবাসীদের গুজবকে এরা বাস্তবে রূপ দিতে পারে যখন তখন।
ঘরের ভেতরে দেওয়াল ঘেঁষে একখানা কাচ লাগানো টেবিল, আর টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ার। চেয়ারে বসে রয়েছে একজন মুখোশধারী লোক। মুখোশধারীর সামনে দাঁড়িয়ে তিন চারটে লোক। লোকগুলোর পকেট থেকে পিস্তলের বাঁট উঁকি দিচ্ছে। ভাড়া করা গুন্ডা নির্ঘাত।
মোটামতো গুন্ডাটা বলল,”যা বলেছেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি বস্ । কিন্তু আসল জিনিসের সন্ধান পেলাম না। শহরের সব সেমিট্রি শ্মশান তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। অবশেষে যদি বা কফিনটা পেলাম কিন্তু কফিনের ভেতরে কিচ্ছু নেই। একটা বাসি মড়া কেবল।”
গুন্ডাটার দিকে তাকিয়ে রাগতভাবে মুখোশধারী বলল, “তোদেরকে এই কাজটা দেওয়াই আমার ভুল হয়েছে। মস্তবড় ভুল। জিনিসটা পেয়েও গর্দভের মতো ছেড়ে চলে এলি ! ওই কফিনের ভেতরেই ছিল জিনিসটা। তোদের মোটা মাথার জন্য পণ্ড হয়ে গেল সব । “
-“মাইরি বলছি স্যার, কিচ্ছু ছিল না ভেতরে।” গলার অ্যাডামস গ্ল্যান্ডে হাত দিয়ে কথাগুলো বলল মোটা। বাকিরা সেই কথায় সমর্থন করল। কিন্তু এতেও চিঁড়ে ভিজল না।
ড্রয়ার থেকে পিস্তল বের করে মোটার দিকে তাক করে মুখোশধারী বলল,”বস ইজ অলওয়েজ রাইট। আমি যখন বলছি কিছু ছিল তখন ছিল। “
ভয়ে কাঁপতে থাকল মোটা। মুখোশধারীর কিন্তু মন টলল না। বেগতিক বুঝে পকেটে হাত দিল মোটা। মৃত্যু যখন সামনে তখন বাঁচার একটা চেষ্টা করতেই হবে। কিন্তু সে চেষ্টা করার সূযোগ পেল না সে, তার আগেই ‘গুড়ুম্’ করে একটা আওয়াজ উঠল। গুলি লাগল মোটার হাতে। আহত হাতটিকে অন্যহাতে ধরে আর্তনাদ করে উঠল সে। আর তখনই আরেকটা গুলি এসে কপালে লাগল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মোটা । বাকিরা ঝড়ের সময় কাশবনের মতো কাঁপতে থাকল।
পিস্তলের মুখ হতে ওঠা ধোঁয়ায় ফুঁ দিয়ে হেসে উঠল মুখোশধারী । বলল, “আমার মুখের উপর যারা কথা বলে তাদের আমি মোটেও সহ্য করতে পারি না।” এরপর পিস্তলটা টেবিলে নামিয়ে রেখে একটা চুরুট ধরিয়ে টান দিতে দিতে বলল, “তোমার জন্য একটা কাজ আছে রশিদ।”
লম্বামতো যে গুন্ডাটা, যার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি সে বলল, “বলুন বস্।”
মুখোশধারী বলল, “আমি যতদূর খবর পেয়েছি ওই কফিনটা এখন ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে আছে। ওটা আমার চাই। যে ভাবেই হোক। খুশি করে দেব। আর খালি হাতে ঘুরে এলে…..”
নির্লিপ্ত মুখে রশিদ বলল,”কোনও চিন্তা নেই বস্, আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন মানে নিশ্চিন্ত থাকুন। ওই কফিন যে ভাবেই হোক আপনার কাছে এনে হাজির করব। না পারলে জান নিয়ে নেবেন। “
নিঃশব্দে হাসল মুখোশধারী, তারপর বলল, “জান যে বাজি রাখতে পারে সেই তো আসল খিলাড়ি । এই স্পিরিটই দরকার রশিদ। আমার জন্য যে জান দিতে তৈরি থাকবে তাকে আমি মালামাল করে দেব।” এরপর মোটার লাশটার দিকে তাকিয়ে বলল,”এই কে আছিস, লাশটাকে নদীর জলে ফেলে দিয়ে আয়। সাবধানে। দেখিস যেন কোনও কষ্ট না হয় ওর।”
লাশটাকে তুলে নিয়ে চলে গেল বাকিরা। কারোর মুখেই আর কোনও ভয়ের ছাপ নেই। ভাবান্তরহীন মুখ সব। এ অনেকটা কশাইখানার মতো। একটা খাঁসিকে কাটছে আর বাকিরা পাতা চেবাচ্ছে নির্লিপ্তমুখে। মানব অনুভূতির কবরখানায় পুঁতে ফেলা হয়েছে ভয়-ভালোবাসা-মানবিকতার মতো অনুভূতিগুলোকে।
সবাই চলে যেতেই একটা গভীর চিন্তায় ডুবে গেল মুখোশধারী। সে চিন্তা যে কি তা ধরার সাধ্য কারোর নেই। এই মুখোশের আড়ালে যে আছে সে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছে অমানবিকতার কাছে। তাই কোনও রক্তেরই মূল্য নেই আজ। বুলেটের ভাষাতেই চলে কথোপকথন।
এদিকে শহর থেকে দূরে একটা আশ্রম। প্রকৃতির কোলে শান্ত নদীর ধারে মনোরম তপোবন। সেই তপোবনের একটা কুটিরে বসে কি যেন হিসেব মেলাচ্ছেন এক পক্ককেশ সাধু।
ইনি হলেন গুরু শাকুন। অলৌকিক ক্ষমতাধর এই সাধু। যা খুশি তাই করতে পারেন। অতি কঠিন রোগকে নিমেষে সারিয়ে ফেলতে পারেন তপোবলে। ফলে শিষ্য ভক্ত অনুযায়ীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়।
একটা অতি পুরোনো হলদেটে বাদামি তুলোট কাগজের পুঁথি নিয়ে হিসেব কষছেন। সেই পুঁথি পড়ছেন আর তা থেকে বিভিন্ন তথ্য নিয়ে একটা খাতায় হিসেব কষছেন। দুর্বোধ্য সব বৈদিক গণিত। অঙ্ক কষছেন আর ঘনঘন তাকাচ্ছেন আকাশের দিকে। হিসেব মিলছে না।
চলবে…