অশ্বত্থামার অস্ত্র – পর্ব ৪
সুব্রত মজুমদার
একটা কালো ছায়া এসে পড়ল তুলোট কাগজের উপর। মাথা না তুলেই শাকুন বললেন, “কি খবর বিভাস ?”
ছায়ার মালিক বলল, “খবর ভালো নয় গুরুদেব। শবাধারের ভেতরে একটা পুরোনো মৃতদেহ ছাড়া কিচ্ছু পাওয়া যায়নি। আমার মনে হয় জিনিসটা এ শহরে নেই। আগেই কারোর হাতে পড়েছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাকুন বললেন, “যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না। আমার গণনা কখনও মিথ্যা হয় না বিভাস। জিনিসটা ওই শবাধারেই আছে। ওই জিনিসটা না পেলে পাঁচ হাজার বছরের পরিশ্রম জলে যাবে। সেই মাহেন্দ্রযোগ আসন্ন বিভাস, ওই জিনিসটা আমাদের পেতেই হবে।”
বিভাস বলল,”শবাধারটি ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে আছে । আমাদের লোক আপ্রাণ চেষ্টা করছে ওই শবাধার উদ্ধারের জন্য। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। দিনচারেকের ভেতরে একটা খবর পাবেনই।”
বেরিয়ে গেল বিভাস । গুরু শাকুন আবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তার গাণিতিক বিশ্লেষণে। দূরে অশত্থগাছ থেকে নেমে এল একটা ইঁদুর। একটা প্যাঁচা গাছের ডাল হতে আতর্কিতে নেমে এসে দুটো পায়ের পাঞ্জাতে আঁকড়ে ধরল সেটাকে। তারপর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ।
তার তীক্ষ্ণস্বরে নৈঃশব্দ ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেল । বৃক্ষশাখায় পাখির দল আর্তনাদ করে উঠল আতঙ্কে ।
পরদিন সকালে সারা শহরে শোরগোল উঠল। কুখ্যাত অপরাধী আহমেদ খুন হয়েছে। পুলিশের অনুমান অন্য কোথাও খুন করে লাশটা নদীতে ফেলে গিয়েছে আততায়ীরা।
সম্ভবত গোষ্ঠীসংঘর্ষ। গুলি কপাল ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ হতে করা একদম অব্যর্থ গুলি । যে গুলি করেছে সে আহমেদের চেনা। খুন করে নদীর জলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল লাশ। স্রোতের টানে কিছুদূর গিয়েই কিনারায় আটকে যায়।
কর্ণেলের কাছ থেকে এই বিবরণ শোনার পর বনমালী ওঝা বলল, “দিনদিন শহরটা মানুষের থাকার পক্ষে অযোগ্য হয়ে উঠছে। এই কাল পর্যন্ত শ্মশানে কবরস্থানে খোঁড়াখুঁড়ি চলছিল, এখন আবার গ্যাংওয়্যার। পুলিশ কি করছে বলুন তো ? সব সাঁট।”
বনমালী ওঝার এহেন কথাবার্তার মাঝেই বিধু ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলেন দারোগা মলিন সামন্ত। এককোণের একটা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,”পুলিশের উপর দোষ চাপানো সহজ কাজ। থাকতেন আমার জায়গায়, বুঝতেন। কত চাপ পিঠ নিয়ে কাজ করতে হয়। তারউপরে উপরওয়ালাদের অন্যায় আবদার তো আছেই। মাঝে মাঝে চাকরি ছেড়ে হিমালয়ে চলে যেতে ইচ্ছা হয় মশাই।”
বিধু ডাক্তার মুখ খুললেন এতক্ষণে। বললেন, “সব পেশারই কিছু না কিছু সমস্যা আছে। যে যা করে সে তার কষ্ট বোঝে। বনমালীর কথায় কান দেবেন না সামন্ত বাবু।”
এসময়ই চা নিয়ে ভেতরে ঢুকল ডাক্তারের কাজের লোক। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দারোগাবাবু বললেন,”মনে করার মতো সময় আমার নেই ডাক্তারবাবু। আমি মরছি নিজের জ্বলনে। “
-“কি হল হঠাৎ ?” ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
দারোগাবাবু বললেন,”আমার কোয়ার্টারে এক ব্যাটা নজর রাখছে। তাকে আবার রাস্তার ধারে জড়িবুটি ওষুধ বেচতে দেখেছে আমাদের কনস্টেবল সুখেন। একটা লোক ছদ্মবেশে এসে আমার কোয়ার্টারে নজর রাখছে কেন ? ওই কফিনটা আনার পর থেকেই যত সমস্যা মশাই। এ নিশ্চয়ই ভূত বা আতঙ্কবাদী। দুটোই সমান ডেঞ্জারাস । আমি আজই আমার ফ্যামিলিকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি। মরলে একাই মরব। “
হেসে উঠল বনমালী । বলল,”পুলিশের যদি এই হাল হয় তবে আম জনতার কি হয় বলুন তো ? আমার তো মনে হয় দেশটা রাজনৈতিক নেতা আর শিল্পপতিদের, আমাদেরকে দয়া করে বাস করতে দিয়েছে। থানায় গেলে আপনি এফআইআর নেবেন না, অসুস্থ হলে হাসপাতালের সিট পাব না, নেতা-মন্ত্রী গেলে রাস্তা ফাঁকা করে দিতে হবে, ইয়র্কি পেয়েছেন !!”
হঠাৎ করে জ্বলে উঠল বনমালী ওঝার চোখ। এ আগুন মলিন সামন্তর চেনা। এই আগুনই পতন ঘটিয়ে ছিল বাস্তিল দূর্গের, ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদন্ড হতে গোপালকে রাজা হিসেবে বাংলার সিংহাসনে বসিয়েছিল এই আগুনই।
তবে বিপ্লবের সন্তান চিরকাল বিপ্লবের হাতেই মরে। আদর্শচ্যুত হতে সময় লাগে না প্রতিবাদীর। আর এটাই মলিন সামন্তর মতো লোকের কাছে স্বস্তি।
মাঝপথে আলোচনা থামিয়ে দিয়ে বিধু ডাক্তার বললেন, “এসব ছাড়ো তো হে বনমালী, বরং একটু ধর্মকথা বল শুনি। তুমি তো আবার মহাভারতের মাষ্টার, মহাভারতের কিছু কথা বল শুনি। এই যে কুরুক্ষেত্রের বিরাট যুদ্ধ, যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, নানান আধুনিক অস্ত্রের প্রয়োগ, – এরপর কি হল ?”
চায়ের কাপটা একপাশে নামিয়ে রেখে একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে নিল বনমালী । এরপর বলল,”এরপর আর তেমন কিছু হয়নি। এরপর প্রায় ছত্রিশ বছর রাজত্ব করেছিলেন যুধিষ্ঠির। মৌষলপর্বের পর পঞ্চপাণ্ডব মহাপ্রস্থানে যান।
মৌষলপর্বের সময়ই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সুদর্শনচক্র অগ্নিকে ফেরত দেন। মৌষলপর্বের পর অর্জুনও তার গান্ডীব অগ্নিকে ফেরত দেন। দিব্য অস্ত্রাদি ফেরত যায় দেবতাদের কাছে।
কিন্তু সবচেয়ে যেটা অবাক লাগে সেটা হল কৌরবপক্ষের দিব্যাস্ত্রগুলোর কি হল ? কোথায় গেল সেগুলো ?”
-“কৌরবপক্ষের শেষ সেনাপতি তো ছিলেন অশ্বত্থামা। তিনি তো অভিশপ্ত। ” বললেন কর্ণেল ।
বনমালী বলল,”ঠিকই বলেছেন কর্ণেল। ঘুমন্ত অবস্থায় দ্রৌপদীর পুত্রদের এবং পরে উত্তরার গর্ভের সন্তানকে হত্যার জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে অভিশাপ দেন। সেই অভিশাপের প্রভাবে দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর প্রেততুল্য হয়ে ভ্রমণ করতে হবে অশ্বত্থামাকে।
আর কপালে যেখানে মণি ছিল সেখান থেকে রক্তপাত হবে ক্রমাগত। ওজন্যই দেখবেন স্নানের আগে অশ্বত্থামার ক্ষতনিরাময়ার্থে মাটিতে তেল নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সে ঘটনার পাঁচ হাজার বছর পেরিয়ে গেছে। ফলে এখন তিনি শাপমুক্ত। “
চলবে….