Subrata Majumdar

অশ্বত্থামার অস্ত্র – ৫
সুব্রত মজুমদার

-“হুঁ ! পরবর্তী মন্বন্তরে তো তিনি সপ্তর্ষির অন্যতম হবেন। ” বললেন কর্ণেল ।

বনমালী বলল,”হ্যাঁ । সেজন্যই তার অমরত্ব। আমার মনে হয় কৌরবদের অস্ত্রশস্ত্র শেষ পর্যন্ত তার কাছেই ছিল। এতসব ঘটনার পর সেগুলো পাণ্ডবদের হাতে তুলে দেবেন বলে মনে হয় না।

ভগবান কল্কি যখন অবতার নেবেন তখন অশ্বত্থামা হবেন তার সেনাপতি। আর সেসময়ই ঐসব অস্ত্র বের করবেন।”

গল্প আরও অনেকদূর গড়াল। বিধু ডাক্তার রোগী দেখেন আর মাঝে মাঝে একটা করে মন্তব্য করেন। আর সেই মন্তব্যের খেই ধরে চলতে থাকে আড্ডা। রোগীরা বিরক্ত হলেও কিছু বলতে পারে না, কারণ তাহলেই চেম্বার থেকে বের করে দেবে বিধু ডাক্তার। ডাক্তারের গরজের দাম লাখ টাকা।

আড্ডার শেষে যে যার ঘরের দিকে রওনা দিল। টুপিখানা মাথায় দিয়ে পাইপটা মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন কর্ণেল। কিছুদূর গিয়েই একটা বাঁক, সেই বাঁক ঘুরতেই একটা গলি। কর্ণেল দেখলেন গলির ভেতরে একটা লোক, লোকটার চোখেমুখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। একটা দেওয়ালের ধারে বসে কাঁপছে। সম্ভবত জ্বর এসেছে।

এগিয়ে গেলেন কর্ণেল। কর্ণেলকে দেখে মুখ তুলল লোকটা, বলল, “আমি খুবই অসুস্থ। আমাকে কি একটু আশ্রয় দেবেন ? একটু আশ্রয় পেলে বেঁচে যাই এ যাত্রা। কিন্তু আমার মতো অচেনা…. “

সময় বড় খারাপ, কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না। কে যে কখন বন্ধুর বেশে এসে ছুরি মারে তা আগে থেকে বোঝা মুশকিল। তবে সে রিস্ক নিতে কুণ্ঠা নেই কর্ণেলের।

সেনাবাহিনীতে থাকার সুবাদে এই ঝুঁকি জিনিসটাকে তিনি গলার মালা করেছেন। শত্রুর চোখে চোখ রেখে কথা বলেন। আবার বিপদের সময় শত্রুকেও রক্ষা করেছেন বারবার। ধর্মযুদ্ধে বিপদগ্রস্ত শত্রুর পাশে না দাঁড়ানোটাই অধর্ম। হোক না এ অজ্ঞাকুলশীল, তবু আশ্রয় দেবেন। আগে থেকেই খারাপ চিন্তা করাটাও তো সঙ্কীর্ণতা।

কর্ণেল বললেন, “কোনও চিন্তা নেই, আমার সঙ্গে আসুন। পরের কথা পরে হবে। “

লোকটাকে সঙ্গে করে ঘরে নিয়ে এলেন কর্ণেল। তিনি অকৃতদার। ঘরে লোক বলতে কাজের লোক কাশীদা। অজ্ঞাত পরিচয় লোকটাকে দেখে কাশীদা বলল, “এ কাকে নিয়ে এলে দাবাবু ? জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তো।”

লোকটাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে ওষুধ নিয়ে এলেন কর্ণেল। কাশীদা গরম গরম স্যুপ নিয়ে এল। ওষুধ আর সুপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল লোকটা। ঘুম ভাঙ্গা ঠিক ভোর সাড়ে চারটেয়। শরীরে জ্বরের লেশমাত্র নেই। স্নান করে পুজোয় বসল লোকটা।

কর্ণেল ভোরে ওঠে। ঘুম থেকে উঠেই লোকটার কান্ডকারখানা দেখে থ হয়ে গেলেন তিনি। যে লোকটার কাল রাতে ধুম জ্বর ছিল সে কিনা ভোরে উঠে ঠান্ডা জলে স্নান করে পুজোয় বসেছে। পুজো শেষ হতেই বিছানায় এসে বসল লোকটা। কর্ণেল ইতিমধ্যে কফি করে এনেছেন।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে লোকটা বলল, “কাল রাতে খুব বিরক্ত করেছি আপনাকে। আসলে সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে আমার। একটা নিরাপদ আশ্রয় দরকার। আমি আমার সব পরিচয় দেব। এরপর যদি আপনার মনে হয় আমাকে আশ্রয় দেবেন তো দেবেন। নাহলে পথের মানুষ পথেই ফিরে যাব।”

-“আগে আমার পরিচয় দিয়ে দি, আমি রিটায়ার্ড কর্ণেল মোহন বক্সী । অকৃতদার। এই কাশীদাই আমার বার্ধক্যের ভরসা। এবার বলুন আপনার পরিচয়। পরিচয়টা তো আগে শুনি পরে যা ভাবার ভাবব।”

লোকটা শুরু করল, “আমার পরিচয় বলতে গেলে বলতে হয় একটা ঘটনা যেটার কিছুটা আপনারা জানেন আর বাকিটার উপর ইতিহাসের রচয়িতা তার কালির দোয়াত উল্টে দিয়েছেন।

ঘটনাটা আজ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের। মহাভারতের যুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছ, অশ্বত্থামা এলেন এক পাহাড়ের কোলে। তার সঙ্গে কয়েক শ’ শকটবোঝাই অস্ত্রশস্ত্র আর সোনারূপো মণিমাণিক। কৌরবদের শেষ সঞ্চয়। রাজা দুর্যোধনের অনুরোধে এসবের দায়িত্ব নিয়েছেন দ্রোণপুত্র। তপস্যায় যাওয়ার আগে এগুলোর একটা বন্দোবস্ত করা দরকার।

অজ্ঞাত পাহাড়ের গোপন কন্দরে সেইসব অস্ত্রশস্ত্র সোনাদানা আর মণিমাণিককে সুরক্ষিত করে তপস্যায় চলে গেলেন অশ্বত্থামা। আড়াই হাজার বছর প্রেমের মতো ঘুরতে হবে তাকে। বহন করতে হবে কপালের ক্ষত। কিন্তু সেই দীর্ঘ সময় তিনি অযথা ব্যায় করবেন না, লাগিয়ে দেবেন মহাদেবের কঠোর ধ্যানে।

অশ্বত্থামা তো গেলেন, কিন্তু যা তিনি রেখে গেলেন তা তো কম নয়। ওই ঐশ্বর্য তো দূর অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান পেলেই সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠা যায় এই যুগে। তাই শুরু হয়ে গেল খোঁজ। খোঁজ শুরু করল একটা গোষ্ঠী যারা নিজেদের কৌরবপক্ষীয় সৈন্যদের উত্তরপুরুষ মনে করে। “

-“স্ট্রেঞ্জ !! তারপর… তারপর….. ” কৌতুহল চরমে উঠল কর্ণেল এর।

লোকটা বলল,”আমি শান্তনু। শান্তনু ব্যানার্জি। পুরাতত্ত্ব বিভাগের সার্ভেয়ার ছিলাম। কাজের সুবাদে ভারতের প্রাচীন ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে ভাসে । যে কোনও ঐতিহাসিককে গুনে গুনে দশগোল দিতে পারি। স্বভাবতই মাটির তলায় শুয়ে থাকা ইতিহাসকে আমি অনুভব করতে পারতাম।

একবার ভারতসরকারের হয়ে একটা দল গেল মহেঞ্জোদারোতে। সৌভাগ্যক্রমে সেই দলে আমার জায়গা হয়ে গেল। চললাম মহেঞ্জোদারো, – মৃতের স্তুপে।

গিয়েই অবাক হয়ে গেলাম। যা পড়েছি বা ছবি-ভিডিওতে দেখেছি তার চেয়েও সুন্দর। সারি সারি ইটের দেওয়াল দাঁড়িয়ে আছে সেই সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীন গৌরবকে তুলে ধরার জন্য। ইতিহাস এখানে কথা বলছে।

চলবে….

Leave a Reply