
অশ্বত্থামার অস্ত্র – ৮
সুব্রত মজুমদার
তিন
জানালার ওপাশে কে ?
কর্ণেল মোহন বক্সীর ঘরে বেশ নিরাপদেই আছেন শান্তনু। সারাদিন শুধু রাশি রাশি বইপত্তর নিয়ে ঘাটাঘাটি করেন। কেবলমাত্র খাওয়ার সময় নেমে আসেন।
সময় সুযোগ পেলেই কর্ণেল যান শান্তনুর ঘরে। কথাবার্তা হয়।তবে শান্তনুর খবর বিধু ডাক্তারের আড্ডার কেউই জানে না।
আজও বিধু ডাক্তারের চেম্বারে আড্ডা জমেছে। আজ মুখটা ভার হয়ে আছে ডাক্তারবাবুর। খুব এমারজেন্সি ছাড়া রোগী দেখছেন না।
জটাধর সরকার বসে বসে রামপ্রসাদী গান গাইছিল। গান শেষ হতেই বনমালী বলল, “কি ব্যাপার ডাক্তারবাবু, আজ কেমন যেন মনমরা মনমরা লাগছে।”
বেশ মিলিয়ে যাওয়া গলায় বিধু ডাক্তার বললেন, “কালকে একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে হে। সেই থেকে খুব টেনশনে আছি। কি করব কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছি না।”
বেশ ব্যাগ্র হয়ে কর্ণেল বললেন, “আপনার আবার কি হল ? গোটা শহরে যা চলছে তাই নিয়ে তো ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছি না, এরউপর আবার নতুন কোন ফ্যাসাদ ? খুব খারাপ কিছু ?”
ডাক্তার চিন্তিত মুখে বললেন,”খারাপ কিনা জানি না তবে বেশ ভয়ে আছি। ঘটনাটা কাল রাতের। আপনারা চলে যাওয়ার পর চেম্বার বন্ধ করে ভেতরে গেলাম। বড্ড খিদে পেয়েছিল। কিন্তু দিনুর কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন ? ও তো ভাত বেড়ে বসে থাকে। হঠাৎ কি হল ওর ?
রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম গোটা রান্নাঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে। আর দিনু গ্যাসের এককোণে সিলিন্ডারের পাশে বসে থরথর করে কাঁপছে। ওর কপাল বেয়ে নেমে আসছে রক্তের ধারা।
-“কি হয়েছে দিনু ?” আমি ব্যাগ্রভাবে জিজ্ঞেস করলাম।
দিনু আমাকে জানালার দিকে আঙুল উঁচিয়ে ঈশারা করল। সেদিকে তাকাতেই আতঙ্কে হিম হয়ে এলো। দেখলাম একটা নীলাভ রক্তের ধারা চলে গিয়েছে জানালার দিকে। আর সেই জানালার শিকগুলো অমানুষিক শক্তিতে বেঁকানো হয়েছে। কেউ যেন তাণ্ডব চালিয়ে ফিরে গেছে জানালা দিয়ে।
সেই নীলাভ রক্তের কিছুটা আঙুলের ডগায় তুলে নাকের কাছে ধরে দেখলাম। একটা আঁশটে ঝাঁঝালো গন্ধ। তবে এটা যে রক্তই সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। দিনুকে বললাম, “কি ছিল ওটা ? তুই দেখেছিস ?”
কাঁপতে কাঁপতেই উঠে এল দিনু। আমার সঙ্গে চেম্বারের দিকে আসতে আসতে বলল, “লোমওয়ালা একটা জন্তু বাবু। মানুষও নয় আবার নেকড়ে বাঘও নয়। ছ’খানা হাত আছে ওটার। ও কিছু একটা বলতে চাইছিল। বুঝতে পারিনি বাবু। আর সেই রাগেই আমাকে খেতে এসেছিল। “
দিনুর কপালে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলাম। ব্যাথার ট্যাবলেটও দিলাম। এখনও আতঙ্ক দূর হয়নি ওর। “
বিধু ডাক্তারের বিবরণ শুনে রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে উঠল সবাই। একমাত্র কর্ণেলের কপালে কোনও ভাঁজ নেই। তিনি বললেন, “আমার কি মনে হয় জানেন, আতঙ্কে আর উত্তেজনায় ভুলভাল দেখেছে দিনু। ভালুক টালুকের পোষাক পরা কোনও চোর ছ্যাচোর এসেছিল হয়তো। “
বিধু ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, “না কর্ণেল, সেরকম নয়। তাছাড়া ওই প্রাণীটার রক্তের নমুনা আমি সংগ্রহ করে রেখেছি। সারারাত ঘুমোতে পারিনি। আমার ল্যাবে আমি পরীক্ষা করেও দেখেছি।
লোহিত বা শ্বেত রক্তকণিকা নেই ওই রক্তে। পরিবর্তে আছে নীলাভ একধরনের রক্তকণিকা যা যে কোনও ফরেনবডিকে নিমেষে ধ্বংস করে ফেলতে পারে। আমাদের লোহিত রক্তকণিকা যেমন অক্সিজেন বহন করে তেমনি ওই রক্তকণিকাগুলো বহন করে নাইট্রোজেন। “
শুনেই চেহারা ঝুলে পড়ল কর্ণেলের। বিধু ডাক্তার ভুল বলার লোক নন। একসময় এই বিধু ডাক্তারও মিলিটারিতে ছিলেন। রিটায়ারমেন্ট নিয়ে জনসেবা করছেন। অতি কম খরচে দুরূহ রোগের চিকিৎসা করেন। খুব গরীবদের কাছে তো টাকাপয়সা নেনই না। হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি আর আয়ুর্বেদ এই তিনটে শাখাতেই তার জ্ঞান অপরিসীম।
জটাধর সরকার গম্ভীর গলায় বলল, “ওয়েরউলফ। নেকড়েমানুষ। কামড়ে দেয়নি তো ? আঁচড়ে বা কামড়ে দিলে শুনেছি আহত লোকটাও নেকড়েমানুষ হয়ে যায়। দিনুকে চোখে চোখে রাখতে হবে ডাক্তার।”
বনমালী সম্মতি জানিয়ে বলল, “ওরকমই তো পড়েছি গল্পে। ব্রিটিশরা তো আর মিথ্যে লেখে না।”
-“উঁহ্…. ব্রিটিশরা মিথ্যা বলে না ! সবজান্তা এসেছেন রে। আমরা যেখানে পরিহাসছলেও মিথ্যা বলতে সঙ্কোচ বোধকরি সেখানে ওরা মিথ্যে যত হোয়াক্স তৈরি করে আমাদের শাসন করল এতদিন।”
বনমালী নিজের যুক্তিতে অনড়। জটাধর বনমালীর পক্ষ নিলে কর্ণেলের পক্ষ নিল মনোহর। একটা বিশ্বযুদ্ধ বাঁধার উপক্রম দেখে মধ্যস্থতায় এগিয়ে এলেন বিধু ডাক্তার।
বললেন,”যা হয়েছে আমার ঘরে হয়েছে। এ নিয়ে কারোর মাথাব্যাথার কারণ তো দেখি না। এখানে ঝগড়াঝাঁটি করলে ধরে ধরে ইঞ্জেকশন দেবো, – একদম ড্রেনের জল দিয়ে। সুতরাং সাধু সাবধান।”
বিধু ডাক্তারকে হাড়ে হাড়ে চেনে সবাই। যে কোনও সময় যা খুশি করে ফেলতে পারে ডাক্তার। তাই ইঞ্জেকশনের ভয়ে চুপ করে গেল সবাই।
বিধু ডাক্তার বললেন,”তর্কের কথা নয়, ওই নমুনা আমি ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠাব । সবাই সাবধানে থাকবেন, বড় একটা কিছু ঘটতে চলেছে। বিপদ যে কোনও দিক হতে আসতে পারে।”
কর্ণেল ফিরে এসে দেখলেন ধ্যানে বসেছেন শান্তনু। লোকটা যেমন জ্ঞানী তেমনি আধ্যাত্মিক মার্গের লোক। কর্ণেলের মাঝে মাঝে মনে হয় যে তার কাছ থেকে অনেক কিছু গোপন করছেন শান্তনু। বড়সড় কোনও রহস্য জড়িয়ে আছে লোকটার সঙ্গে।
বিধু ডাক্তারের ঘরে হওয়া ঘটনাটা বললেন কর্ণেল। শুনে শান্তনু বললেন, “বৃকাসক।”
-“বৃকাসক ? সেটা আবার কি ?” অবাক হয়ে বললেন কর্ণেল।
চলবে…