
অশ্বত্থামার অস্ত্র – ৯
সুব্রত মজুমদার
-“বৃকাসক হল এক ধরনের নরপিশাচ যারা আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ, কিন্তু সময় সুযোগ বুঝে নরনেকড়ের আকার ধারণ করতে পারে। বৃকাসক অবস্থায় এদের রক্তের গঠন হতে ডিএনএ গঠন সব পাল্টে যায়। খুব ভয়ঙ্কর এরা। আমাকে যারা খুঁজছে তাদের সাথেই আছে একদল বৃকাসক।”
শুনে গোলগোল হয়ে গেল কর্ণেলের চোখ, এ যেন রূপকথার গল্প শুনছেন তিনি। এও কি হয় ? তবে বিধু ডাক্তার ভুল দেখেন না বা বলেন না। অপরপক্ষে শান্তনুও বিধু ডাক্তারের গল্পকে সমর্থন করছে। সুতরাং গল্পের বাস্তবতা আছে।
কিন্তু বৃকাসক যদি শান্তনুর খোঁজে এখানে এসে হাজির হয় ! প্রশ্নটা শান্তনুকেই করলেন কর্ণেল।
শান্তনু বলল, “ভয় নেই, আপনার ঘরের চারপাশে এক ধরনের চূর্ণ ছড়িয়ে দিয়েছি। সেই চূর্ণের প্রভাবেই এই ঘরে ঢুকতে পারবে না বৃকাসক। আমি সে ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছি। তবে ওরা ছাড়বে না। আমাকে খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করবে।”
শান্তনুর কথায় রীতিমত ভয় ধরে গেল কর্ণেলের। বৃকাসক যে কখন আসবে তা বলা মুশকিল। কাশীদাকে ডেকে কর্ণেল বললেন,”অচেনা কাউকে ঘরে ঢুকতে দেবে না। সময় খারাপ। আর ওই লোকটার উপর একটু নজর রাখবে। অস্বাভাবিক কোনকিছু দেখলে আমাকে বলবে।”
কাশীদা মাথা নেড়ে বলল,” আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন বাবু, এই কাশীদা থাকতে আপনার ঘরে একটা ছুঁচোও ঢুকতে পারবে না। আর ওই বাবু ? উনাকে নিয়ে আপনার চিন্তা নেই। লোক চিনতে ভুল হয় না আমার। খুব ভালো লোক। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন বাবু। “
সন্ধ্যা হয়ে এল। শহরের আলোগুলো একে একে জ্বলে উঠেছে। নাগরিকেরা বেরিয়েছে তাদের প্রমোদ ভ্রমণে। বিভিন্ন খাবারের স্টলের সামনে জমেছে ভিড়। কেউ আলুকাবলি খাচ্ছে তো কেউ এগরোল। রেস্টুরেন্টের সামনে লাল কাপড় ঢাকা বিরিয়ানির হাঁড়ি।
একটা আইসক্রিমের ঠ্যালাগাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। বেশ সুন্দরী। চুলগুলো চাইনিজ কাঁটা দিয়ে আটকানো, ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে যে মেয়েটির ঠোঁটের দুটো প্রান্ত দিয়ে লিপস্টিকের একটা সরু রেখা গড়িয়ে আসছে। রুমাল দিয়ে মুছে নিল মেয়েটি।
বহুক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জায়গাটা একটু কোণার দিকে বলে লোকজন তেমন আসছে না। ঠ্যালাওয়ালা স্বভাবতই বেশ বিরক্ত। সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, “আইসক্রিম দেব দিদিমণি ?”
ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি খেলিয়ে মেয়েটি বলল, “কি কি ফ্লেভার আছে ?”
-“ভ্যানিলা, চকলেট, ম্যাঙ্গো, পাইনআপল…..”
-“হিউম্যান ব্লাড ফ্লেভার হবে ?” শুধাল মেয়েটি।
ঠ্যালাওয়ালা বুঝতে না পেরে বলল, “কি ফ্লেভার বললেন দিদিমণি ?”
-“হিউম্যান ব্লাড…. মানুষের রক্ত….” এই বলে মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ল ঠ্যালাওয়ালার উপর। ঘাড়ের শিরাতে দুটো। দাঁত বসিয়ে দিল অক্লেশে। পান করতে লাগল টাটকা তাজা রক্ত।
কিছুক্ষণ ছটফট করতে করতে শান্ত হয়ে এল ঠ্যালাওয়ালা। পিপাসা মিটে গেলে দেহটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল মেয়েটি। তারপর মিলিয়ে গেল গলির অন্ধকারে।
একটু পরেই অন্ধকার ফুঁড়ে একটা লোকের আবির্ভাব হল। কাঁধে অফিসের ব্যাগ ঝোলানো। সম্ভবত অফিস থেকে সরাসরি বাজারে এসেছে। কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরবে। আইসক্রিমওয়ালার দেহটাকে পড়ে থাকতে দেখে দেহটার দিকে ঝুঁকে বসে পড়ল লোকটা। দেহটাকে উল্টে পাল্টে অবশেষে নজর পড়ল ঘাড়ের উপর দুটো দাঁতের দাগের দিকে।
-“এখানেও এসে পড়েছে দেখছি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিঃশব্দে কাজ সেরে লুকিয়ে পড়ে। খুব ধুরন্ধর। তবে যাই কর না কেন বাপু আমার হাত হতে নিস্তার নেই তোমাদের।” বিড়বিড় করে বলল লোকটা। এরপর দেহটাকে ওভাবেই ফেলে রেখে নিজের পথ ধরল।
পরদিন সকালেই খবরের কাগজ আর টিভি সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল আইসক্রিমওয়ালার রহস্যমৃত্যুর কথা। বিধু ডাক্তারের চেম্বারেও সেই আলোচনা ঝড় তুলল।
বিধু ডাক্তার বললেন,”নাহ্, আর এই শহরে নয়। এসব আর নেওয়া যাচ্ছে না। আমি ভেবেছি কয়েকদিনের জন্য চেম্বার বন্ধ করে আমার গ্রামের বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। ওখানে ওসবের ঝামেলা নেই। শুধু প্রকৃতির অনাবিল সৌন্দর্য। তোমরা কেউ যাবে নাকি আমার সঙ্গে ?”
-“আমাকে সঙ্গে নিয়ো ডাক্তার। কাশীদার হাতে ঘরের দায়িত্ব দিয়ে কয়েকদিন বেড়িয়ে আসব তোমার সঙ্গে। এ শহরে আমারও মন বসছে না।” বিষন্ন মুখে বললেন কর্ণেল।
বনমালী ওঝাও রাজি। জটাধর বলল,”আমিও সঙ্গ ধরছি তোমাদের। দিনকয়েক গ্রামের খোলা হাওয়া গায়ে লাগলে মনের সব ভয়-ডর হাওয়া হয়ে যাবে।”
ঠিক হল আগামী কাল সকালেই রওনা হবে তারা। অন্তত দিনপনেরো। তারপর সবকিছু থিতু হলে শহরে ফিরবেন। একটা নতুন কিছুর আশা নিয়ে ঘুমোতে গেল সবাই। অনেকদিন পর পোড়া শহরটা ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। অনেকদিন পর।
চলবে….
