Subrata Majumdar

Subrata Majumdar

অশ্বত্থামার অস্ত্র – ১০

সুব্রত মজুমদার

শান্তি কর্ণেলের ভাগ্যে নেই। বিধু ডাক্তারের উপদ্রব এসে হাজির হল কর্ণেলের ঘরের সামনে। সে এক রোমহর্ষক ঘটনা। খেয়েদেয়ে সবে শুয়েছেন কর্ণেল হঠাৎ কার ডাকে যেন ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানায় উঠে বসলেন।

চারপাশে কেউ কোত্থাও নেই। টেবিলে রাখা জলের গ্লাস হতে জল খেলেন। আবার শুয়ে পড়লেন।

একটু পরে আবার সেই ডাক। “কর্ণেল বক্সী… কর্ণেল বক্সী….” একটা পরিচিত মেয়েলি গলা। আওয়াজটা জানালার দিক থেকে আসছে। পারমিতা ?

চোখের সামনে ফুটে উঠল একটা আঠারো কুড়ি বছরের মেয়ের স্নিগ্ধ মুখ। পারমিতা। যাকে একবার না দেখলে কিচ্ছু ভালো লাগত না। যার খোঁপায় বেলকুঁড়ির মালা পরিয়ে দিয়ে সেদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত মোহন। জগৎসংসার যাই বলুক এরা একে অপরের পরিপূরক। একজন গান হলে অপরজন তার সুর, একজন দেহ হলে অপরজন তার প্রাণ। অচ্ছেদ্য।

কিন্তু এ সুখ সহ্য হল না নিয়তির। সব ওলটপালট করে দিল সে। কলেজের বাস যাচ্ছিল সিমলা। হৈহৈ করতে করতে যাচ্ছিল সবাই। হাসি ঠাট্টা গান মজা। হঠাৎই একটা জোরে আওয়াজ হল। সামনের একটা জিপের সাথে ধাক্কা লাগল বাসটির। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাইয়ে পড়ে গেল গোটা বাস।

বাস যখন পড়ছে তখন মোহন আর পারমিতা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চেয়ে আছে উভয় উভয়ের দিকে। কারোর মুখে কোনও কথা নেই। এভাবেই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে পৌঁছে যেতে চায় তারা জীবনের ওপারে, যেখান থেকে ফেরা যায় না। যে নিয়তি ভেবেছিল মৃত্যুর অমোঘ আঘাতে দলেপিষে দেবে ওদের প্রেমের শতদল, সে নিয়তি ব্যর্থ। ব্যর্থ ওদের দুজনের প্রেমের কাছে।

‘নিয়তি কে ন বাধ্যতে’ – নিয়তি কারোর বাধ্য নয়। সে যা করে তা করে নিজের খেয়ালে। সে যে চিত্রনাট্য লেখে তার জুড়ি মেলা ভার। সে কারোর পছন্দ অপছন্দের ধার ধারে না। এবারও তাই দর্পচূর্ণ হল প্রেমের। সে ভেবেছিল যে তার শক্তি অপার। সে পাথরে ফুল ফোটাতে পারে, ছন্দ আর আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারে জীবন, কাছে আনতে পারে দুটো মনকে। কিন্তু নিয়তি তার চেয়েও প্রবল।

দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর উদ্ধারকাজ শেষ হল। মাত্র দশটা দেহ মিলেছে। এদের মধ্যে ছ’টা নিথর নিস্পন্দ। বাকি চারটের মধ্যে একজন হল মোহন। পারমিতার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুধু পারমিতার কথাই ভেবেছে মোহন। সবাই তাকে নানাভাবে বুঝিয়েছে যে এতটা নিচে পড়লে বাঁচা অসম্ভব। মোহনদের দেহ একটা পাথরের খাঁজে আটকে ছিল, বেশি নিচে গড়িয়ে পড়েনি বলে রক্ষা। মোহন কিন্তু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে পারমিতা বেঁচে আছে। একদিন না একদিন দেখা হবেই তাদের।

এরপর অনেকটা পথ। সেনাবাহিনীতে ভর্তি, একাত্তরের লড়াই, কার্গিল পেরিয়ে এই ছোট্ট শহরে অবসর জীবনযাপন। জীবনসায়াহ্নে এসে বারবার মনে পড়ে পারমিতার কথা। ওকে ভুলতে পারেননি কর্ণেল মোহন বক্সী। ভোলা যায় না। সেজন্যই তো আর কারোর সাথে ঘর বাঁধা হলো না।

-“কে ? পারমিতা….”

জানালার ওপাশে একটা ছায়ামূর্তি কাতর কণ্ঠে বলল, “আমি মোহন। আমি তোমার পারমিতা। বহুদিনের অপেক্ষা… বহুদিন পরে তোমায় খুঁজে পেয়েছি। জানালা খোলো মোহন।”

কর্ণেল বক্সী জানালা খুললেন। জানালার ওপারে পারমিতা। শ্রাবণের বিদ্যুৎপুঞ্জের আলোকে স্পষ্ট দেখা যায়। সেই কোঁকরানো চুল, চাইনিজ কাঁটা দিয়ে গোছানো কুন্তল আর ঠোঁটের উপর টকটকে লাল লিপস্টিক।

তড়িঘড়ি দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন কর্ণেল। আজ তার মনের উদ্বেলতা শ্রাবণের হাওয়ার চেয়েও বেশি। এতদিন যার প্রতীক্ষায় তাকে হঠাৎ কাছে পেলে কি নিজেকে থামানো যায়।

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখলেন জানলার ধারে কেউ নেই। আশেপাশে কেউ কোত্থাও নেই। শ্রাবণের পুবালির দমকে যেন সব দীপ নিভে গেল হঠাৎ করে।

অনেক খোঁজাখুঁজির পরেও যখন পারমিতাকে পেলেন না তখন বিষন্ন মনে ফিরে এলেন ঘরে। ঘরে ঢুকতেই দেখলেন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে শান্তনু। স্মিত হেসে শান্তনু বললেন, “পারমিতার দেখা পেলেন ?”

-“আপনি কিভাবে জানলেন পারমিতার কথা ?” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন কর্ণেল।

শান্তনু বললেন, “আমি সব জানি। যে চলে যায় তাকে ফিরে পাওয়ার ইচ্ছা না রাখাই ভালো কর্ণেল। আজ যে মৃত্যু আপনার দুয়ারে এসে ফিরে গিয়েছে সে তো নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবে না। সাবধানে থাকবেন। “

নিজের ঘরে চলে গেলেন শান্তনু। বিকট শব্দে কোথাও বাজ পড়ল। সেই আলোতে চমকে উঠে কর্ণেল দেখলেন জানালার ওপারে শিউলি গাছের তলায় দাঁড়িয়ে এক নারীমূর্তি। পারমিতা।

                          চার
                   নিঃশব্দ ঘাতক

                                        শহর থেকে অনেক দূরে একটা ছোট্ট গ্রাম।  সবুজে ঘেরা সেই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা নদী । নদীটি বছরের অন্যান্য সময়  ক্ষীণস্রোতা হলেও বর্ষার জলে ভয়াল ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। বছরের অন্যান্য সময় নদীর সরু ধারায় স্নান করে মেয়ে-বৌরা, বালি খুঁড়ে নিয়ে যায় খাবার জল। আর পাশের ছোট্ট দ'-তে ঝাঁপাঝাঁপি করে একঝাঁক ছেলেমেয়ে ।

নদীর এই ভরা যৌবন দুকুল ছাপিয়ে ঢুকে পড়ছে পার্শ্ববর্তী মাঠগুলোতে। ঝাঁকে ঝাঁকে মাছের ঢুকছে সেই জলের সাথে। আর সেই মাছধরার জন্য ভিজে গায়ে জাল হাতে করে মাঠের এপ্রান্ত হতে ওপ্রান্ত ছুটে বেড়াচ্ছে কয়েকটা লোক। ওদের কোমরে বাঁধা বাঁশের খারুই বা খালুই। মুখ সরু এই খালুইয়ের ভেতরে মাছ ভরে দিলে সহজে বেরিয়ে যেতে পারে না।

চলবে….

Leave a Reply