বড় গল্প
পারফিউম
স্বাগতা ব্যানার্জি
আমাকে একটু বাড়ী পৌছে দেবেন?
ট্রাফিক পুলিশ হতচকিত হয়ে পিছনে ফিরে দেখে ২৫-২৬ বছর বয়সি একটা বিবাহিত মেয়ে তাকে বলছে এই কথা।
পুলিশ বাবু বলেন বাড়ির ঠিকানা বলেন,উবের করে দিচ্ছি। কোথায় যাবেন?
মেয়েটি আরো করুন হয়ে বলল, বাড়ী?
পুলিশ বাবু বল্লেন হ্ম্ম কোথায়?
মেয়েটি কিছুক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো।তারপর সরে গেলো।
পুলিশটি তার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
অনীক বাড়ি ঢুকেই তিন্নী বলে এক হাঁক দিতেও তিন্নী সাড়া দিলো না। এদিক-ওফিক ,ছাদ,বাথরুম,বারান্দা ঘুরেও যখন পেলো না তখন চিন্তায় পড়ে গেলো।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বাইকের চাবি আর ফোন নিয়ে দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
কদিন আগেই অনেক ঝড় ঝাপ্টা পেরিয়ে বিয়ে হয়েছে তিন্নী আর অনীক এর। অনীক এক নামকরা অফিসের সিনিওর এক্সিকিউটিভ। তিন্নী ওই কম্পানির ই ইন্টার্ন।
আনীক একা, কারো সাথে কাজের বাইরে কথা বলে না। কেমন জেনো মিশুক না। আর তিন্নী ঠিক উল্টো । অনর্গল কথা বলতে থাকা, কথায় কথায় হাসিতে ঢলে পড়া, অনেক বন্ধুদের সাথে হই হই করা এক প্রানবন্ত মেয়ে। কি করে যে দুজনের দুজন কে ভালো লাগলো তা ঈশ্বর ই জানেন,কিন্তু ওই opposites attrack s more,এ কারণেই মনে হয় এরাও আজ বিবাহিত। আর একটা গন্ধ তিন্নী কে অনীকের কাছে বেঁধে রেখেছিল।অনীকের এক পারফিউম।তিন্নী থেকে থেকেই বলতো যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি,এই গন্ধ আমায় ঠিক তোমায় চিনিয়ে দেবে।
দুজনে দুজন কে এতো ভালোবাসে যে সকলেই বলে হর গৌরীর জুটি।
তিন্নীর বাবা মা অনীক কে ভীষণ স্নেহ করেন। তাই অনাথ অনীক অনেকটাই বাবা মা র স্নেহ পাচ্ছে।
সব যখন একেবারে খাপে খাপ চলছে ,ঠিক তখন ই তিন্নী গেলো হারিয়ে। অনীক পাগলের মত খুঁজলো। তিন্নীর বাবা মা ,পুলিশে খবর দিল,কাগজ,টিভি কিছু বাদ দিলো না কিন্তু তিন্নীর কোনো হদিস কেউ দিতে পারল না। প্রায় 6মাস কেটে যাবার পর তিন্নীর বাবা একদিন অনীক কে ডেকে বললেন বাবা,জীবন অনেক বড় ,তুমি সারা জীবন এভাবে নষ্ট কর না। তিন্নী কে ভুলে আবার শুরু করো।
আমরা আমাদের মেয়ে কে ভুলতে তো পারবো না,কিন্তু তুমি আবার বিয়ে করে সেটেল হও।
অনীক খুব মন দিয়ে শুনে বলল।বাবা জানেন তো মেয়েরা পরগোত্রে চলে গেলে তার সকল দায় দায়িত্ব তার স্বামীর। আমি আমার মত ই ওর জন্য অপেক্ষা করবো। এমনি তেই হিন্দু শাস্ত্র বলে হারিয়ে যাওয়া সঙ্গির জন্য 7 বছর অপেক্ষা করতে হন। আমিও তাই করবো।
অনীক প্রথমেই অফিসে একটা ছুটির দরখাস্ত দিলো। প্রায় এক মাসের। অফিস তার এই সুদক্ষ কর্মি টি কে হারাতে চায় না। ছুটি মঞ্জুর হল।
এবার অনীক তার পিঠের রুকস্যাক তৈরী করে বেড়িয়ে পড়ল হিমালয়ের উদেশ্যে।কথায় বলে সমুদ্রের বিশালতায় অনেকেই হারিয়ে যায়,কিন্তু পাহাড় দুহাত বাড়িয়ে তোমার দুঃখ ভোলাতে সাহায্য করে। অনীক গেল পাহাড়ে।
প্রতিদিন ভোর থেকে উঠে একটা কিছু নিয়ে মেতে থাকা,কিছু ভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। কিন্তু কোনভাবেই অনীক তিন্নী কে ভুলতে পারে না। বরং ভুলে থাকার চেষ্টায় সে আরো বেশি মনে পড়ে। তিন্নীর অভ্যাস ছিল সব কিছু ভিডিও করা। অনীক পাগলের মত সেই ভিডিও গুলই দেখতে থাকে। এভাবেই এক ভিডিও পায় সে। দেখে তিন্নী কাঁদছে,আর বলছে জানো, আমি তোমায় খুব ভালবাসি। আমি জানি আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। তুমি রাগ কর না ,আমি এক জটিল Alzheimer’ রোগে ভুগছি। ডাক্তার বলেছে আমি খুব দ্রুত সব কিছু ভুলে যাচ্ছি।একদিন তোমাকেও ভুলে যাবো।
কিন্তু আমি তোমাকে ভুলে থাকতে চাই না। তাই কোনদিন যদি হারিয়ে যাই ভুল বুঝনা আমায়। জানো, আমি জানি তুমি কিছুতেই এই রোগ মানবে না আমার সাথেই শেষ নিশ্বাস অবধি থাকতে চাই বে,কিন্তু এভাবে কষ্ট পাবে তুমি তা ভেবেই কেমন পাগল হয়ে যাচ্ছি। তাই প্রতিদিন সব কথা খাতায় লিখে রেখে মনে রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু সময় নেই।তোমায় ছেড়ে আমি বেঁচে থাকবো ঠিক, কারন ডাক্তার বলেছে হয়তো তখন ছোট বেলার কথা মনে পড়বে,তারপর সেগুলো য় হারিয়ে যাবে। তখন হয়তো শেষ হবো আমি। আমি তোমায় হারাতে চাই না কিন্তু আমি জানি আমি ই হারিয়ে যাবো, আর তুমি কিছুতেই এটা মানতে পারবে না। আমি বলি কি,
তুমি নতুন করে শুরু করো। জানো, আমি তোমায় অনেক ভালবাসি।
ভিডিও টা এখানেই শেষ । অনীক ভাবতে বসে কেন ?কেন সে আগে দেখেনি?
পাহাড় থেকে ফেরার কথা ছিল 15 দিন পর,অনীক চলে আসে বাড়িতে। সারা বাড়ি জুড়ে তিন্নীর স্মৃতি । এখন বোঝে সে কেন তিন্নী সারা বাড়ি জুড়ে ফটো সেঁটে রেখেছে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে সে তিন্নীর প্রেস্ক্রিপ্সান,বা অন্য কোন তথ্য। পেয়েও যায়। খাতা টাও পায় ডেস্কে।
সকাল বেলা অনীক একটা চ্যেম্বারে বসে আছে। মনোবিদ ডাক্তার আকাশনীল ব্যানার্জি র চেম্বার।
তিন্নীর ফটো দেখাতেই চিনতে পারলেন। বললেন কেমন আছেন?অনীক জানালো সে ভালো নেই কারন তিন্নী হারিয়ে গেছে।
ডাক্তার ব্যানার্জী বললেন সেকি কেন? উনি আপনাকে ভালো রাখতেই নিজেকে সরিয়েছেন, আর আপনি ভালো নেই কেন? যান গিয়ে দেখে আসুন ,আর কখনই হারাতে দেবেন না।
চমকে উঠলো অনীক।
কোথায় আছে সে?
কেমন আছে সে?
আমায় চিনতে পারবে কি?
কে তার খরচ চালায়?
ডাক্তার যে গল্প বলল এবার, তা এজেবারে থ বানিয়ে দিলো অনীক কে।
ডাক্তার বলেন,তিন্নি ভুলতে শুরু করে যখন, তখন একবার ভুলে রাস্তায় হারিয়ে যায়। অনেক কষ্টে পুলিশ ধরে কোনোভাবে তার বাবার বাড়ী যায়। বেশ কিছুক্ষন পর যখন মনে পড়ে তখন কিভাবে এ বাড়িতে এসেছে কিছুতেই মনে করতে পারছিল না। কিছু কিছু জিনিস খুব দ্রুত ই ভোলে এর মধ্যে অনীক কেও কিছুতেই মনে আনতে পারেনি। অর বাবা এই ডাক্তারের কাছে খুব দ্রুতই নিয়ে আসেন।ডাক্তার বাবু বলেন এ এক বিরল Alzheimer’s disease.
তিন্নী জানায় অনীক কে কোন কষ্ট ই সে দেবে না তাই তার থেকে দুরে তাকেই যেতে হবে। তার বাবা তাকে সাহায্য করে। যাবার আগে তিন্নী তাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞ্যা করিয়েছে,কোন অবস্থাতেই তিনি তিন্নী কোথায় আছে বলতে পারবেন না।
অনীক কি করবে ঠিক করতে পারে না।।ডাক্তার কে জিজ্ঞাসা করে ,ও কি সব ভুলে গেছে?আমাকে?
ডাক্তার বলেন উনি প্রতিদিন বেঁচে থাকেন আপনাকে ভেবেই,আপনি যান,নিজে ওর জীবন যত দিন ,তত দিন থাকুন ও র সাথে।
অনীক বের হন। আজ তার মনে হচ্ছে কেন ঈশ্বর।তাকে দুটি পাখা দেয় নি।
কলকাতা থেকে বেশ কিছুটা দুরে ক্ষীর ভবানি গ্রাম।
সুন্দর কটেজ চারিদিকে নানা রং এর ফুল ফুটে রয়েছে। তার মধ্যে এক ছাতিম তলায় নিবিষ্ট হয়ে তিন্নী কিছু করছে। অনীক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। তিন্নী মুখ তুলে তাকায়, অনীক বলে কেমন আছেন?
তিন্নী বলে আমি কি আপনাকে চিনি?
অনীক ম্লান হেসে বলে না।
অনীক বলে আপনি একটু আমার সাথে যাবেন?
তিন্নী নাক টেনে বলে এই গন্ধটা আমার খুব চেনা,আমার খুব খুউউব চেনা।
অনীক কাঁদতে শুরু করে,তিন্নীর আরো কাছে এগিয়ে যায়। তিন্নী কে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে,তিন্নী বলে , বলেছিলাম।না আমি তোমায় ভুলে গেলেও এই গন্ধ টা ঠিক তোমায় চিনিয়ে দেবে,আমি কি তোমায় আবার হারিয়ে ফেলবো?
অনীক কপালে চুমু এঁকে বলে এই তো তোমায় জড়িয়ে আছি, ঠিক গন্ধের মত ই , আর কি করে হারাবে?
আসলে তিন্নী অনীকের এরপর কি হয়েছিল আমিও জানিন্না।বলা ভাল জানতে চাই না। শুধু চাই তিন্নী যত দিন ই বাঁচুক অনীকের বুকেই বাঁচুক।
অনীকের অই গন্ধ শুধু তিন্নীর ই হোক।
স্বাগতা ব্যানার্জি