Utpal chakraborty

কাব্যগ্রন্থঃ ছায়াপথ জুড়ে জুড়ে
কবিঃ গোপাল লাহিড়ী
প্রকাশকঃ পাঠক
মূল্যঃ ২০০ টাকা
আলোচকঃ উৎপল চক্রবর্তী

জীবন মানেই এক রহস্যময় যাপন। শব্দ-নৈঃশব্দ, আশা- নিরাশা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, ভরসা-অভরসার চাপান-উতোর।
কবি গোপাল লাহিড়ীর “ছায়াপথ জুড়ে” কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতায় প্রায় সেরকমই গা-ছমছম সংঘাত, আনন্দ ও জখমের উচ্চারণ। কখনও তা স্পষ্ট কখনও বা তা ছায়াময় বা ছায়াশ্র‍য়ী।
কবিতার শরীর যে এক অতি সূক্ষ্ম অনুবাদের বিষয়ান্তর তা শুধুমাত্র এই বইটি পড়লেই তা স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হয়।

কবি তাঁর চলার পথের বাঁকে বাঁকে যে মেঘ, যে রংধনু দ্যাখেন তাই স্পন্দিত হয় তাঁর চিন্তন জগতে আর সেখান থেকেই একে একে ভেসে আসে প্রতিক্রিয়া শব্দের আকারে।
‘তেলরঙ’ কবিতাটি যেন কবির দীর্ঘ ছায়াপথ ভ্রমণের একটা সংক্ষেপিত প্রতিধ্বনি, একটা পরিত্যক্ত জীবন কাহিনীর টাইম ল্যাপ্স ভিডিওগ্রাফি।
” মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে রাস্তার ধারে/ জীবিত না মৃত? জানতে চায়নি কেউ।”
আধুনিক জনজীবনের যে দুঃখ জনক পরিবর্তন তার ভয়ংকর রূপ এক অপরূপ নান্দনিক ভাষায় ধরা দেয় যখন কবি বলেন, “সাদা মেঘ যেতে যেতে ঝরে পড়েছে নর্দমায়/ তাজা রক্ত তবু চারপাশে।”
“গোলাপের ঠোঁটে আজ ভয়ঙ্কর বিষ।”

কবি এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি তুলে এনেছেন আরেকটি বিপুল রঙ, যেন সেটাই ক্যানভাসের আসল ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর।
“পৃথিবী কী ভীষণ ঠান্ডা!” ভীষণ ঠান্ডা কেন? পৃথিবী দেখেও দেখে না কিছু। আসলে সে এক প্রতিবাদহীন মৃতের শরীর।

এই মৃত পৃথিবী আর মায়া ছড়াতে পারে না তাই। জীবনের অমৃত আজ কোনওভাবেই উপলব্ধ নয়। ভালবাসবার মতো জীবনে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
শুকনো পাতা জ্বালিয়ে বেঁচে থাকাই জীবন। তাই কবি অশ্রুসিক্ত শব্দে লেখেন, “জীবনকে জড়িয়ে ধরে কেউ কাঁদে না এখন।”

কবি পৃথিবী জুড়ে দিনের পর নামা রাতকে রাত বলেন না। রাতের বদলে তিনি দেখেন ছায়াপথ ঢেকে থাকা এক ‘আশ্চর্য অন্ধকার’। উল্লেখ্য যে এই শব্দবন্ধটি যেন এক বিস্ফোরণ। যার সপ্লিন্টার বিভিন্ন কবিতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পাঠকের মনেও তার আঘাতের চিহ্ন। কবি নিজেই বিমূঢ় কারণ তিনি দেখেন কীভাবে অন্ধকার শুষে নিয়েছে রক্ত। কীভাবে বাঁকা চাঁদের একাকীত্ব জুড়ে ‘গা ছমছম’। কীভাবে “ঘুমের মধ্যেই ঝরে পড়ে বাঁচার সময়।” কীভাবে বেজন্মা শিশুতে ভরে যাচ্ছে দেশ। সংগ্রহের আগে এনজিও জানতে চায় তারা ছেলে নাকি মেয়ে( এই শহর)।
যত এগিয়েছে লেখা তত দেখা যাচ্ছে এই অন্ধকার ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা নিয়ে আরও গাঢ় হয়ে উঠছে। অন্ধকার শব্দটি তাই আর রেপিটেটিভ মনে হচ্ছে না।
“বিষপাতা শুষে নেয় সঞ্চিত রসটুকু।/ এভাবেই অন্ধকার পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে/ এভাবেই হাড়গোড় ভেঙে দিয়ে নিঃশব্দে চলে যায়।” ( রক্তমাখা ছায়া বিতান)।

“আকাশ যেন আজ এক আশ্চর্য অন্ধকার” ( থেমে যাওয়া)।

“কালো আকাশের নিচে আমাদের ভীষণ ভয়/ কেউ কখনও আলোর পথ দেখায় না।”( এপাশ ওপাশ)।

এই অন্ধকার তো বোঝাই যাচ্ছে সাধারণ অন্ধকার নয়। কিন্তু আরও কুৎসিত হয়ে ধরা দিচ্ছে যখন কবি দেখতে পান যে কেউ ঠিক পথ দেখাতে চান না।

“যেখানে অন্ধকারের পাশে থাকে কেবল প্রতিহিংসা/ বিদ্যুতের শাসানি। ( জন্মবীজ)”
বিদ্যুতের শাসানি খারাপ আবহাওয়ার সঙ্কেত বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু একটা প্রাকৃতিক পরিঘটনা এখানে এক অপূর্ব ভাবনার স্থাপত্য তৈরি করল।

“কালো ছেলে কালো মেয়ে স্রোতে ভেসে যায়/ একমুঠো অন্ধকার নিয়ে উড়ে গেল দুটো পাখি”।( এক মুঠো অন্ধকার)।

এক মুঠো অন্ধকার শব্দের প্রয়োগ এখানে একই সঙ্গে যেমন মিটোনিমি তেমনি সাইনেথেসিয়ার উদাহরণ।

” আলো নেই, দুজনে সরে যাই অন্ধকারে”(এগিয়ে যাওয়া)।
এখানেও অন্ধকার শব্দটি এক কষ্টদায়ক অতিবাস্তবতা ও অধিবাস্তবতার অনুভবে সম্প্রক্ত হয়ে উঠল।

“কোথাও হয়নি রক্তপাত, তবু গ্রাস করছে অন্ধকার/ মনের ভেতরে শুধু ভয়, সামনেই মৃত্যুর চোরাবালি।” ( স্বপ্ন সন্ধান)।

এরকমই “অদ্ভূত আঁধার,” ও ,” বিপন্ন বিস্ময়” ভরা কবিতাগুলি।
কবিতাগুলি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পৃথিবীর নিষ্ঠুর গমন ও চলন। কবিতাগুলি যেমন করুনরস সিক্ত, তেমনি যেন এক দ্রোহ-প্রভা চর্চিত। “আত্মসমর্পণ” কবিতায় কবি সরাসরি তুলে ধরেন তারই তথ্যচিত্রঃ
” সারাদিন রক্তক্ষরণ পথে পথে/ জলে ধুয়ে যায় সন্ত্রাস/ স্বপ্ন নয় ভীষণ সত্যি।”

“মোহন বাঁশি” কবিতাতেও তার প্রতিধ্বনিঃ
“নামার জন্য ওঠা আবার ওঠার জন্য নামা/ পায়ে মাড়ানো ধুলোয় মাখা ছিল, যে প্রতারণা।”

এত এত অবজেক্টিভ ভাবনার মধ্যেও কী ব্যক্তিগত ক্ষোভ আক্ষেপ, স্মৃতিকাতরতা, রোম্যান্টিসিজম নেই? নিশ্চয়ই থাকবে। থাকার তো কথাই। কারণ কাব্যগ্রন্থের নাম ছায়াপথ জুড়ে। যেখানেই ছায়া সেখানেই নস্টালজিয়া ও লিরিসিজমের প্রচ্ছায়া। পেজ উলটে উলটে ৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় পেয়ে গেলাম উত্তর।
দরজা খুলতেই ঢুকে এল সন্তর্পণে / হোগলা বন, কচুরিপানার নীল নীল ফুল/ টেবিলের উপর রাখা সাদা পৃষ্ঠা/ ছোট ছোট অক্ষর, ধূসর রঙের দু’একটি লাইন।” ( এমন কিছু স্মৃতি)
শৈশবে ফিরে যাওয়ার আর্তি ফুটে উঠেছে “লজ্জাহীন শৈশব” কবিতায়ঃ
“কাঁসার থালায় নিলাম ছাইচাপা আগুন/ ঢেকে রাখা হল বড়োবেলা/ দাও ফিরিয়ে লজ্জাহীন শৈশব।”

“খেলা যখন” কবিতায় প্রবীণ কবির চোখে নেমে আসে আবারও আগোছাল কিছু স্মৃতিকাতরতাঃ
“গেরুয়া বিকেল ছায়া ফেলে গেছে/ দুএকটি তারা নেমে আসে সাবধানে/ পায়ের ছাপ রেখে যায় বাগান জুড়ে।”

“আমাদের গল্প” কবিতায় সেই নস্টালজিয়ায় স্পষ্টতম ছবিঃ
“পরতে পরতে মিশে আছে গোপন স্মৃতি ও লুকোনো কোনো অনুভূতি।”
হয়তো বা পুরনো কোনও বন্ধু বা হারিয়ে যাওয়া প্রথম প্রেমের সুখময় স্মৃতির আঘাতে কবির চোখের কোন চিকচিক করে উঠছে আর পাঠকও একাত্ম হয়ে যাচ্ছে সেই মনকাড়া অমোঘ অনুভবের ঘনত্বে।

“কষ্ট মুছে গেছে এই ভেবে যে তুমি আছ কোথাও/ তোমার ঘুমের মধ্যে যেন কোথাও আমি আছি/ আমরা দুজনে নিঃশব্দে আমাদের গল্প বুনে যাচ্ছি।”

“ঘুমের মধ্যে” কথাটা কিন্তু অনেকগুলো ভাবনা বয়ে আনতে পারে। সাবজেক্টিভ থেকে অবজেক্টিভ হয়ে উঠতে পারে এক লহমায়। ঘুম এখানে যেমন মৃত্যু, হারিয়ে যাওয়া, থেকেও না থাকার প্রতীক, তেমনি ঘুম স্মৃতিহীনতারও প্রতীক হতে পারে।

কবির “হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা” কবিতায় এই নস্ট্যালজিয়া হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার অপূর্ব চিত্রকল্পে উচ্চারিত হয়। মনে পড়ে কবি অক্ষয় কুমার বড়ালের কবিতার লাইন, ” ছায়া ছায়া কত ব্যাথা ঘুরে ধরা ধামে।”
এই ব্যাথা বা বিচ্ছেদ যতই কষ্টের হোক না কেন, তারাও যেন একটা অদ্ভূত নেশা ধরার টান তৈরি করে। তাই বিচ্ছেদ যেমন কষ্টের তেমনি অদ্ভূত আনন্দেরওঃ ” চেনাজানা ধরা বাঁধা ছবি থেকে কী/ কোনও রঙিন মুহূর্ত সৃষ্টি হয়?/ বাতাসে ফিরে আসে সেই অজানা শিহরণ।”

“ঘুমের ভেতরে পুকুরের সিঁড়ি ভেঙে নেমে যায় অতীত/ জলাভূমি লুপ্ত শহর ও টুকরো স্মৃতি।” ( কাঁচ পাতা)

“তবু যাওয়ার আগে গোপনে দেখা ক্ষত স্থান/ অনুতাপহীন সন্ধ্যেবেলায় মোমবাতির ফুরিয়ে যাওয়া।” ( বর্ণমালা)

এ যেন এরিস্টটলের “প্লেজার প্রপার টু ট্রাজেডি”-র প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু এই প্লেজারের মধ্যে যে প্রতারণা, দহনের ছবি লুকিয়ে আছে তা কখনও নিঃশব্দে ব্যক্তিকে অতিক্রম করে হয়ে ওঠে ব্যষ্টি জীবনের জলছবিঃ

” আস্তে আস্তে পৃথিবী দখল করে নেয় ধূসর পাথর… আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় বেঁচে থাকার ইচ্ছে।” (জন্মবীজ)

“তারপর ফেরেনি কখনও শব্দেরা/ মিথ্যে কথা বলেছিল সময়।” (অপেক্ষা)

“কালো কালিতে ঢেকে যায় পৃথিবী/ যদি অন্তরিন হতে হয় তোমাকে, জ্বালাই আগুন,/ দহনের জ্বালা, যেন বিষের মতো রাত।” (ডালপালা)

বিশ্বাস হীনতার ছবি এঁকেছেন Matthew Arnold। তিনি তাঁর Dover Beach কবিতার তৃতীয় স্তবকে লিখেছিলেন,
“The Sea of Faith
Was once, too, at the full.”
“ছায়াপথ জুড়ে” কাব্যগ্রন্থের ‘সূচনা’কবিতায় সেই ভাবনারই স্পষ্ট প্রতিধ্বনিঃ
‘একদিন সম্পর্কের গঠন ছিল কেমন আলাদা/
আসলে বেঁচে থাকার তো এক নিখুঁত অঙ্গীকার ছিল’।( সূচনা)

“আর কোনো বিশ্বাস নেই/ জলে ভেসে যায় জন্মবীজ, স্মৃতি ও শব্দমালা।” ( জন্মবীজ)

ভেঙে যায় ভেঙে পড়ে পুরনো সাঁকো/ আয়নায় মুখ, উপেক্ষা ও অপমান।”

বিস্ময়কর অন্ধকারের হাত ধরে কবিতায় প্রবেশ করে সন্দেহ। সজাক দৃষ্টি। কবি সমাজকে আতস কাঁচ দিয়ে দেখতে থাকেন আর নিজেকেও আয়নার সামনে দাঁড় করান।
তাঁর চোখ এড়িয়ে যায় না মেরুদণ্ড হীন মানুষের ছবি। কবি শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত “হামাগুড়ি” কবিতায় আমরা আমাদের তথা বৃহত্তর সমাজের মজ্জাহীনতার কষাঘাত অনুভব করেছি। এত বছর পরও বর্তমান সমাজ চিত্র একটুও পালটায়নি। কবি গোপাল লাহিড়ির ‘কাঁচপাতা’ কবিতায় তার স্পষ্ট ছাপঃ
“কাঁচ পাতা ঘন শীত চোখ জল/ নিজের শরীর থেকে খুলে রেখেছি মেরুদন্ড।”

কবির এই স্বীকার উক্তি আসলে ঘুরিয়ে বলা ব্যষ্টির ব্যর্থতার, নীতিহীনতার কাহিনী।

“একটা মুখের সঙ্গে আরেকটা মুখের কত পার্থক্য।” (ঝোড়ো সময়)

“আসলে আমাদের সারাটা জীবনই এক লজ্জা/ মজ্জাবিহীন অস্থিহীন স্বপ্নহীন কাহিনী।” ( আমরা মুখোমুখি)

এত দুঃখ। এত যন্ত্রণা। এত অপমান। এত উপেক্ষা। এত হতাশা। ভেঙে যেতে যেতে তবুও তো স্বপ্ন দেখি আমরা। এটাই তো সেই পোয়েটিক স্পিরিট, যা ডিস্টোপিয়া তুলে ধরবে ঠিকই, কিন্তু আশা জাগিয়ে রাখবে। কবি বলবেন আমরা যে বেঁচে আছি তার প্রমাণ আমাদের গায়ে ঝড় এসে লাগেঃ

“ফিরিয়ে আনো ঝোড়ো সময়।
আমরা বেঁচে আছি বলেই এই ঝোড়ো হাওয়া/ ঠান্ডা কাঁচের শার্সি থাকুক উন্মুক্ত।” (অন্তরা থেকে সঞ্চারী)।

এখানেও তাই কবি স্বপ্ন দেখছেন বাঁচার। চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখার আমরণ চেষ্টা করে যাওয়ার প্রয়াস। অচেতন মৃত্যুর চেয়ে সজ্ঞান মৃত্যুই তো শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের একান্ত চাওয়া। আর সেখানেই জিতে যাওয়া।
“পাঠক্রম” কবিতায় কবি তাই বলেন, “ইচ্ছে করে বাঁচতে আরও ইচ্ছা করে/ নতুন হয়ে ধুলোর রেণু মাখলে পরে।”

কবি গোপাল লাহিড়ির কবিতার এক বিশেষ দিক তাঁর ইমেজ নির্মাণ ও মেটাফরের স্থাপত্য।
“পাশাপাশি” কবিতায় এরকমই অসাধারণ কিছু চিত্রকল্প মন ছুঁয়ে যায়।
কবি শেষ লাইনে লিখছেন, ” স্মৃতি যেন এখন পায়ে পায়ে মাড়ানো ধুলো।”
“ছিপছিপে নদী পা ভিজিয়ে দিলে ভারী খুশি।” যেমন অপূর্ব চিত্রকল্প তেমনি মনোরম পারসনিফিকেশন।

“জানালার কাঁচে অপমান আর হিম” ( ছায়াপথ জুড়ে জুড়ে)।
এই লাইনটি যেন এই কবিতার পিভট। যার উপর হিঞ্জ করে আছে কবিতার খোলা জানালাটি। জানালার কাঁচে শুধু হিম জমলে সেটা হত সাধারণ একটা ন্যারেটিভ। কিন্তু যখন অপমান শব্দ জুড়ে দেওয়া হল তখন লাইনটি বহুমাত্রিক হয়ে গেল। জানালার কাচ তখন আর জানালার কাচ রইল না। হয়ে উঠল স্মৃতির ভেজা সেলুলয়েড। পরিত্যক্ত জীবনের দূরবীক্ষণের কুয়াশামাখা গ্লাস। অপমানের রাগ-লজ্জা শিরায় শিরায় ঢেলে দিল হিম শীতলতা।

“সিলিঙে ঝুলছে বাঁকা নীল চাঁদ”।( ৩০)। এই লাইনে সিলিঙ আকাশের রূপক হিসাবে খুব সুন্দর দেখায়। নীল চাঁদ কেন? হয়তো নক্ষত্রের দূরাগত নীল আলোয় আভাসিত বলেই কবির চোখে চাঁদটি নীল। বাঁকা হতে পারে অমাবস্যার ঠিক পরেই যে চাঁদ দেখা যায়, তার মতো দেখতে তাই।
এরকমই অসংখ্য মনকাড়া চিত্রকল্পে ভরা কবিতাগুলো।

‘লজ্জাহীন শৈশব’ কবিতায় লিখছেন,
“ঘুমপাতার ওপর শুয়ে আছে কাঁচপোকা।”

‘টুকরো কবিতা’ থেকে আরেকটি উদাহরণ তুলে দেওয়া যায়।

“ভোরবেলা বালিহাঁসের ডানায় মুছে যাচ্ছে অন্ধকার।”
লাইনটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর “হাট”কবিতার একটা অনুরূপ বিপরীতধর্মী ইমেজ ভেসে আসেঃ

“নির্জন হাটে রাত্রি নামিল একক কাকের ডাকে।”

এই কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে রং। বিশেষ করে হলুদের বিভিন্ন শেড খুব চোখে পড়ে। যেমন শিল্পীর ক্যানভাসে একই রঙের শেডের ঘনত্বের রকমফেরে একেকটি আবহ তৈরি হয়, একেকটি অর্থ প্রকট ভাবে ধরা দেয়, তেমনি কবির হাতেও হলুদ একেক রকম বিস্তৃতি, ব্যাপ্তি ও অনুসঙ্গ নিয়ে ধরা দেয়। হলুদ রং যেমন ক্ষয় ও ধ্বংসের প্রতীক( “Yellow, and black, and pale, and hectic red,/ Pestilence-stricken multitudes”- Ode to the West Wind by Shelley),তেমনি এর একটা পজিটিভ দিক তো আছেই। হলুদ রং আমাদের মন ভাল করে দেয়। ১৭নং পেজের ‘পাঁশুটে হলেদেটে বিকেল’ আর ‘হলুদ হয়ে যাওয়া পাতা’ নিশ্চয়ই এক নয়। আসলে অন্ধকার শব্দটিকেও যেমন কবি কখনও আশাভঙ্গের আবার কখনও আশাবাদের মোড়কে ব্যবহার করেছেন( হাতে হাত ঘষে ঘষে স্বাগত জানাও তাজা অন্ধকারকে), তেমনি হলুদ রংও দ্বৈত ভূমিকায় এখানে দেখা দিয়েছে। “হলুদ পাখির চোখে সাম্যের গান”-লাইনটিতে হলুদ রং ভিন্ন ভিন্ন অর্থ জন্ম দিতে পারে। আবার স্বাভাবিক ভাবে দেখলে এর একটা অতি সাধারণ প্রাকৃতিক দিকও আছে।
“যে আনন্দে জমিয়েছি পাখির পালক হলুদ সবুজ পাতা” এই লাইনে কিন্তু হলুদ রংটি ডাইনামিজমের প্রতীক, না হলে সবুজের আনন্দের সঙ্গে তার সহাবস্থান হত না কখনও।

অধিকাংশ কবিতা পোস্ট মডার্ণ অস্তিত্বহীনতার সঙ্কট, যাপনের জটিলতা ও আশাভঙ্গের রসে জারিত। তাই সেখানে এলিয়টের অবজেক্টিভ কোরিলেটিভ থিয়োরি নির্ভর আবেগের পরোক্ষ ডিসকোর্স। স্বভাবতই সেখানে গদ্যছন্দ ও মুক্ত গদ্যের প্রাধান্য। তবে বেশ কিছু কবিতায় মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তের সুনিপুন প্রয়োগ।

৫ মাত্রার তিন পর্বের কিছু কিছু মাত্রাবৃত্তে দেখি অসাধারণ অন্ত্যমিল সহ ধ্রুপদী কাব্যের শিহরণঃ
“সারাটা রাত ঘুমিয়ে আছে চুকিয়ে ঋণ/ লুকানো কথা খুঁজতে হবে রাত্রিদিন।” (লুকানো কথা)
৫+৫+৫+২ মাত্রার তিন পর্বের “মোহনবাঁশি” কবিতাটি কাপলেটে ভরা চোদ্দ লাইনেরঃ
” প্রশ্ন ছিল বনিবনার অভাব আছে কিনা/ ভোর রাতেই শিউলিফোটা মোহনবাঁশি বীণা।”

পাঠক্রম কবিতায় ৫ মাত্রার তিন পর্বে লেখা লাইনগুলো ( বন্ধুরা সব- শুধু এখানে এক মাত্রা বেশি) এক ঝলকে দেখলে স্বরবৃত্ত বলে ভুল হতে পারেঃ
“ইচ্ছে করে বাঁচতে আরো ইচ্ছে করে/ নতুন হয়ে ধুলোর রেণু মাখলে পরে/
বন্ধুরা সব মাথায় নিল শব্দঝুরি/
পিছিয়ে থাকি বুঝতে পারি ছল চাতুরী।” আসলে ‘পাঠক্রম’ কবিতাটি এমন যে মাত্র তিনটি জায়গায় সামান্য পরিবর্তন সাপেক্ষে, এটি একই সঙ্গে অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের অনন্যসাধারণ উদাহরণ হয়ে থেকে যেতে পারে ছন্দরসিকের কাছে।

কবি গোপাল লাহিড়ি একজন আদ্যোপান্ত কবি। তাঁর ইংরেজি বাংলা মিলে ১৯ টির মতো কাব্যগ্রন্থ আছে, চার পাঁচটি ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ আমি পড়তে পেরেছি মাত্র। কিন্তু কোনও বাংলা কবিতাই ইংরেজির অনুবাদ বলে মনে হয়নি।
তাই প্রত্যেকটি কবিতাই স্বতন্ত্র। এটাও কবির কবিতার এক অনুপম দিক। উনার এই কাব্যগ্রন্থটি পড়ুন। ভাল লাগবে এইটুকু বলতে পারি।

Leave a Reply